এক.
শিরিন অর্ধচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। অন্ধকারের মাঝে নদীর পাড়ের কিছু আলো এসে পড়ছে তার চোখে। মনে হচ্ছে এই আলোটুকুই তার শেষ সম্বল। একবার যদি চোখ বন্ধ হয়ে যায় তাহলে আর এই আলো দেখা যাবে না৷ শিরিনের গা জ্বলে যাচ্ছে৷ সে আবারও রক্তবমি করল। এবার তার চোখ বন্ধ হয়ে আসলো।
“তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?”
শিরিনের মুখ নীল হয়ে গেল। সে তার সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করছে—
“কে? কে ওইখানে?”
“চিৎকার করলে শরীর আরও খারাপ হবে৷”
শিরিন কোনো মতে উঠে বসল। চারদিকে ঘন আধার।
সে আবারও বলল, “কে কতা কয়?”
আবারও উত্তর এলো, “আমি,”
“আমি কে?”
“তুমি আমাকে চিনবে না। তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?”
“আফনের পরিচয় কী?” শিরিন নিজেকে সামলাতে পারল না। মাটিতে পড়ে গেল।
“আমি পরার্ধ।”
শিরিন পিছনে তাকিয়ে দেখে একটা তরুণ ছেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখদুটো কেমন যেন ভয়ঙ্কর!
“আফনে কী চান? আফনের পরিচয়?”
“আমি তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি। তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি।”
শিরিন কিছু বুঝতে পারছে না। কী হচ্ছে তার সাথে?
“আফনে কই থাকেন?”
“আমি থাকি তোমাদের মাঝে আবার খুব দূরে।”
শিরিনের মাথা গুলিয়ে আসছে। সে কোনো কথা বলছে না।
পরার্ধ বলল, “তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?”
“হু”
“ওরা তোমাকে কেন মারল?”
“আমি জানি না। বড়ো আফার জামাইয়ের ট্যাকা চুরি হইছে। হেরা মনে করছে আমি চুরি করছি। কিন্তু আমি কিছু করি নাই৷” শিরিন থেমে শ্বাস নিল। তার চোখ দপদপ করছে, তাকাতে পারছে না।
সে বলল—
“আমি জানি ট্যাকা কই আছে। বড়ো আফার জামাই ট্যাকা পলায় রাখছে। আর হে আমারে ফাঁসাইছে। কেন ফাঁসাইছে জানেন? ওই বুইড়া বেডার কুনজর পড়ছে আমার উপর!..” শিরিন হাঁপাচ্ছে আর নদী পাড়ের আলোয় তার চোখটা চকচক করে উঠছে।
“শিরিন, তোমার যদি এখন অনেক টাকা থাকত তাহলে তুমি কী করতে?”
শিরিন হাঁপাতে হাঁপাতে বলল—
“আমি আমার মতো মাইনষ্যের লেইগা একটা সুন্দর কামের জায়গা বানাইতাম। যেহানে সবাই সুন্দর মতন কাম কইরা জীবনডা চালাইতে পারব।যেইখানে কেউ কারো উপর কুনজর দিব না!"
পরার্ধ বলল–
“শিরিন, তোমার এখন বিশ্রামের দরকার। তুমি আরাম করো।”
শিরিন অচেতন হয়ে পড়ে রইলো নদীর পাড়ে। চারিদিকে ব্যস্ত নিরবতা। ঠান্ডা আলোয় শিরিনের মুখটা কেমন যেন লাগছে, মনে হচ্ছে দীর্ঘবিষাদে জড়িয়ে গেছে এই তরুণীর স্বপ্নময় জীবন। যে শুধু একটু সুন্দর মতো বেঁচে থাকতে চায়!
দুই.
দুইদিন পর শিরিন সুস্থ হলো। জ্ঞান হারানোর আগে তার স্মৃতি জুড়ে অচেনা এক তরুণের দৃশ্য। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন সে দেখে সে তার বস্তিতে শুয়ে আছে। সে এখন কিছুটা সুস্থ। দুপুরে শিরিন ভাত চড়িয়ে ঘর দেখে বের হলো। এমন সময় দেখলো দুইটা লোক তার দিকে এগিয়ে আসছে।
লোক দুটো তাকে জিজ্ঞাসা করল—
“আপনার নাম কি শিরিন সুলতানা?”
“জ্বে” -শিরিনের বুক ধ্বক করে উঠল।
“আপনার বাবা তালুকদার স্যার তার সকল জায়গা-সম্পত্তি আপনার নামে লিখে দিয়েছেন। গত পরশু উনি মারা গেছেন। এই নেন আপনার দলিলপত্র। ”
শিরিন দলিলগুলো নিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো৷ সে ছোটোবেলা থেকে বড়ো হয়েছে এতিমখানায়। আর এই লোকদুটো বলছে তার বাবার সকল সম্পত্তির মালিক সে! শিরিন কিছু বুঝতে পারছে না। লোকগুলো চলে গেল, শিরিন এখনো পুরোপুরি বিস্মিত।
বিকেল পড়ে যাচ্ছে, শিরিন বসে আছে দরজার সামনে।
কে এই তালুকদার সাহেব? তিনি শিরিনকে কীভাবে চিনলেন? এই টাকাগুলো কি আসলেই তার! নাকি ভুলে অন্যের টাকা তার কাছে চলে এসেছে? সে কি টাকাগুলো রেখে দিবে, নাকি ফিরিয়ে দিবে? সবকিছু কি ফিরিয়ে দেয়া যায়? এইসব বিষয়ে চিন্তা করতে করতে সে ঘোরের মধ্যে চলে গেল।এমন সময় তার কাছে তার নানার চিঠি এলো। চিঠিটা হলো—
“শিরিন মা,
আমার তো শরীর-সাস্থ ভালা না।গ্রামে আমার কিছু জমিজমা আছে। বুড়া বয়সে এই জমিজমার ঝামেলা আর ভাল্লাগে না রে! জীবনটা তো শেষ হইয়া আসতাছে। আমি এই জমিগুলো বেঁইচা তরে কিছু ট্যাকা পাঠাইলাম। তুই খরচ করিস।
ইতি
তোর নানা”
এইটা পড়ার পর সে অস্থির হয়ে গেল। তার দৃষ্টি বিক্ষিপ্ত, শিরিনকে দেখাচ্ছে উন্মাদের মতো! তার নানার তেমন কোনো জমি আছে বলে তো তারজানা ছিল না। অথচ তিনি এতগুলো টাকা কীভাবে পাঠালেন?
তিন.
শিরিন অফিসে বসে আছে। একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হওয়ার কথা। কিন্তু টেলিফোন করে সেটা কেনসেল করা হয়েছে। শিরিন টেবিলে শুয়ে পড়ল, তার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।
“কেমন আছো শিরিন?”
শিরিন চমকে উঠল।
“চিনেছ আমাকে?”
শিরিন বলল,“জ্বী, আপনি পরার্ধ।”
“কেমন আছ তুমি?”
“ভালো।”
“৫ বছর আগে তুমি বলেছিলে তোমার টাকা থাকলে তুমি অন্যের সহায়তা করতে। আমি সেই ব্যবস্থাই করেছিলাম। ”
“আমি জানি। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।”
“কিন্তু তুমি কি তোমার কথা রেখেছ?”
“জ্বী, আপনি তো দেখতেই পারছেন এই অফিস আমার দেওয়া। এখানে কারো কোনো সমস্যা হয় না,সবাই সুন্দর মতো কাজ করে এখানে।”
পরার্ধর ভয়ংকর গলা শুনে শিরিনের মাথা এলোমেলো হয়ে গেল।
“শিরিন, তুমি মিথ্যে বলছো। তুমি তোমার কথা রাখনি। তুমি ব্লেস্ক কোম্পানির ট্রায়ালকৃত ওষুধ অনুমতি ছাড়া খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়াচ্ছ। তুমি দেখছ অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে, কিন্তু তুমি থামছ না। ”
শিরিনের মুখ নীল হয়ে গেছে।
পরার্ধ বলল, “মানুষের জীবন হলো চক্রের ন্যায়। এই চক্র নিয়ন্ত্রিত হয় মানুষের ভাবনা দিয়ে। যেমন ভাবনা তেমন প্রাপ্তি।”
শিরিনের ঘোর ভাঙল কাপ ভাঙার শব্দে। যে ছেলেটা চা আনতে গিয়েছিল, সে চা দিতে গিয়ে কাপ ভেঙে ফেলেছে। শিরিন তার দিকে রক্তবর্ণে তাকিয়ে রইলো। শিরিনের মাথা ধরেছে তাই কিছু বলল না। শুধু বলল—
“ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলো, বাড়ি যাবো। ”
পরার্ধের কথা শিরিনের কানে এখনো বাজছে।
কে এই পরার্ধ? সে কি আমাদের মতোই কোনো প্রাণী, যার কাছে টাকার কোনো মূল্য নেই? নাকি সে অন্য কোনো সত্তা! কি তার রূপ!
শিরিনের ভাবনা ব্যাঘাত ঘটল গাড়ির ঝাঁকুনিতে। সে ড্রাইভারকে বলল—
“মকবুল, এভাবে গাড়ি চালাচ্ছো কেন?”
সে কথাটা বলার সাথে সাথেই আরেকটা ঝাঁকুনি খেল। এবার সে ধমকে উঠল।
মকবুল জড়ানো গলায় বলল,
“ম্যাডাম, মনে হইতাছে গাড়ি ব্রেক ফেল করছে। ”
মকবুলের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সে আবারও বলল, “আমি আইজ সকালেই গাড়ি ঠিক করাইছি। কিন্তু কেমনে কি হইলো বুঝতেছি না!"
শিরিন মকবুলের কথা শুনে থমকে গেছে। তার মাথা ব্যথা এখনা আর নেই। তার বুকে ব্যথা করছে। এখনি হয়তো পরার্ধর গলা শোনা যাবে। সে বলবে,"যেমন ভাবনা তেমন প্রাপ্তি।" এতো কষ্ট করে টাকা উপার্জন করে তার কি লাভ হলো। বরং টাকার ভাবনায় সে হয়ে গিয়েছিল বিভৎস!সে মনে মনে আর্তনাদ করছে,
“পরার্ধ এমন করো না। আমি বাঁচতে চাই, একটু সুন্দর মতো শ্বাস নিতে চাই। ”
মকবুল ঘামে ভিজে গেছে। সে বারবার চেষ্টা করছে গাড়ির গতি কমিয়ে আনতে। কিন্তু কোনো এক আধ্যাত্মিক কারণে গাড়ির গতি বেড়েই যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে কোনো এক ভয়ঙ্কর সত্তা তাকে বেঁধে রেখেছে। সে কিছুই করতে পারছে না৷ আর গাড়ি ক্রমাগত ছুটছে, জোরে ছুটছে…!
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ গল্পটি "ইরিনা" নাটক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা হয়েছে। সংগতভাবেই নাটকের গল্পের সাথে এই গল্পের কাহিনি, প্লট বিন্যাসের কোনো মিল নেই। মিল আছে এক অচেনা সত্তার দিকটাতে। "শিরিন" একটা রূপক কল্পগল্প।