প্যাসকেলের দরজায় টরিসেলি



শুরুর কথাঃ


বিজ্ঞানী টরিসেলি প্রচন্ড অসুস্থ। ঠিক মতো কথা বলতে পারেন না, খেতে পারেন না। যাকে বলে মুমূর্ষু অবস্থা।  টরিসেলি নিজের মনে বিড়বিড় করছেন-


“প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। কিন্তু পরীক্ষাটা আমি যতবার করেছি তত বারই শূন্যস্থান দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কেন? তাহলে আমাদের ভাবনা কি ভুল! আমরা যেভাবে ভাবছি প্রকৃতি সেভাবে কাজ করছে না!”


ডাক্তার তার বাঁচার আশা ছেড়ে দিলেন। কিন্তু অলৌকিকভাবে হলেও সত্যি,কিছুদিন পর টরিসেলি সুস্থ হয়ে উঠলেন। যেই পরীক্ষার ফলাফল দেখে তিনি মুমূর্ষু অবস্থায় ছিলেন, সুস্থ হয়ে তিনি আবার সেই পরীক্ষা করলেন। কিন্তু ফলাফল ঐ একই। টরিসেলি বুঝতে পারলেন, তিনি কোনো বিপ্লবী নিয়ম আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু তিনি তখনো জানতেন না কেন প্রকৃতি এমন আচরণ করে। তিনি শুধু এতটুকুই জেনেছেন, প্রকৃতিকে আমরা যেভাবে দেখছি সে ঐভাবে কাজ করে না, যদি ঐভাবে কাজ করতো তাহলে টিউবের উপরে ফাঁকা কোনো জায়গা থাকতো না।



এই ঘটনার বহুবছর পর প্যাসকেল বুঝতে পারলেন টিউবে কেন শূন্যস্থান তৈরি হলো। এই লেখাটা টরিসেলির সেই বিপ্লবীক পরীক্ষা ও বায়ুমন্ডলের চাপ নিয়ে।  এই লেখার প্রতিটি ব্যাখ্যা নিউটনীয় মেকানিক্স অনুসারে। আমাদের পৃথিবী পৃষ্ঠে খুব সুন্দর মতো নিউটনীয় বলবিদ্যা কাজ করে। আমি এই লেখায় মূলত ভাবনার জায়গাগুলোকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্ঠা করেছি, নিউটনীয় বলবিদ্যার সাহায্যে।


 



১.



টরিসেলির এক্সপেরিমেন্টের কথা শুরুতেই বলা হয়েছে। কিন্তু এই এক্সপেরিমেন্ট কিভাবে কাজ করে, এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা সম্পর্কে কিছু বলা হয় নি। প্রথমেই একটা জিনিস বলে রাখি, উপরের গল্পে টরিসেলির বন্ধুর যে চরিত্র বলা হয়েছে এবং তার যে কাজ বলা হয়েছে ,সেটা শুধুমাত্র আমার কল্পনা। কিন্তু গল্পের ভাবটা সত্যি। এখন দেখি কি ছিল এই টরিসেলির পরীক্ষা আর কিই বা তার জনপ্রিয়তার কারণ!

 



টরিসেলি এই পরীক্ষাটা করেন ১৬৪৩ সালে। এই পরীক্ষার যতটা না বৈজ্ঞানিকভাবে চাঞ্চল্যকর, তার চেয়ে বেশি চাঞ্চল্যকর দার্শনিক দিক থেকে। কিন্তু কেন?



টরিসেলির পরীক্ষার সিস্টেম বা সজ্জাটা ছিল খুব সুন্দর। এখন একটু ভাবি, একটা গ্লাসে পানি নিয়ে যদি গ্লাসটা উল্টো করি তাহলে কি হবে? অবশ্যই পানি মাটিতে পড়ে যাবে। যাকে বলে, পপাত ধরনিতল।



এখন চিন্তা করো, আমার হাতে একটা পারদ দিয়ে ভরা টেস্টটিউব,  আমি যদি এটা উলটো করি অবশ্যই পারদ নিচে পড়ে যাবে । আমি এখন এই কাজটা আরেকটু বুদ্ধি খাঁটিয়ে করব। এবার পারদে ভর্তি টেস্টটিউবটি আমি অন্য একটি পারদে ভর্তি মগ বা পাত্রের উপর উল্টো করে চেপে ধরি। এমনভাবে চেপে ধরেছি যাতে টেস্টটিউব থেকে কোনো পারদ পড়ে না যায় অথবা কোনো বাতাস ভিতরে ঢুকতে না পারে (চিত্রঃ ০১ দ্রষ্টব্য)। আর এটাই ছিল টরিসেলির এক্সপেরিমেন্টের সিস্টেম। টরিসেলি ১০০ সেন্টিমিটারের একটা পারদে ভর্তি টেস্টটিউব অন্য একটি পারদে ভর্তি পাত্রে লম্বভাবে চেপে ধরেছিলেন।


 


এখন পরীক্ষার ফল কি হবে? অবশ্যই টেস্টটিউবের পারদগুলো মগের পারদের সাথে মিশে টেস্টটিউব খালি হয়ে যাবে। 


কিন্তু বাস্তবে এমন হয় না। বাস্তবে টেস্টটিবের ২৪ সেন্টিমিটার পর্যন্ত পারদ অন্য পাত্রের পারদের সাথে মিশে যেতে পারে। বাকি ৭৬ সেন্টিমিটার পারদ টেস্টটিউবেই থেকে যায়! আমাদের সেন্স তো বলে সবটুকু পারদ মিশে গিয়ে টেস্টটিউব খালি হয়ে যাবে কিন্তু সেখানে সামান্য কিছু পারদই মিশতে পারে। এই প্রশ্নটাই ভাবিয়েছিল টরিসেলিকে। তখনকার সময়ের দার্শনিকরা মনে করতেন, প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, প্রকৃতিতে শূন্যস্থান থাকতে পারে, যা হলো টেস্টটিউবের উপরের ২৪ সেন্টিমিটার ফাঁকা জায়গা। আর এই জন্য এই এক্সপেরিমেন্টটা এতো বেশি বিখ্যাত। 


আর ঐ ২৪ সেন্টিমিটার ফাঁকা জায়গাকে বলা হয় “টরিসেলির শূন্যস্থান”। টরিসেলির এই পরীক্ষা এতোই চমৎকার যে, ২০১৩ সাল পর্যন্ত ব্যারোমিটারে (বাতাসের চাপ মাপার যন্ত্র) এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। আর এই লেখাটার মূল উদ্দেশ্য টরিসেলির এক্সপেরিমেন্টের সাহায্যে বাতাসের চাপ বের করা।




কিন্তু প্রশ্ন এখানেই শেষ না! চাপ কি? বাতাস চাপ দিলে তো আমাদের শরীর অক্ষত থাকতো না, তাহলে বাতাসের চাপ কোথায়? এছাড়া কেনো ৭৬ সেন্টিমিটার পারদ অন্য পাত্রের পারদের সাথে মিশল না? এই উত্তর জানতেন না টরিসেলি নিজেও। যার উত্তর পরবর্তীতে দেন প্যাসকেল! এখন আমরা শুনব প্যাসকেলের সেই অপরূপ ব্যাখ্যা। তার আগে আরেকটা প্রশ্ন, টরিসেলি কেনো এই এক্সপেরিমেন্টে পারদ ব্যবহার করলেন, অন্য কোনো তরল কেনো না?


ভাবতে থাকো তোমরা, এই ফাঁকে আমি শোনাতে থাকি প্যাসকেলের বিবৃতি।





২.



প্যাসকেলের ব্যাখ্যাটা ছিল প্রবাহীর মধ্যে চাপের প্রভাব নিয়ে। 


এখন এখানে দুইটা প্রশ্ন, চাপ কি? আর প্রবাহী কি? চলো, চাপ কি সেটা জেনে আসি। চাপ মানে হলো কোনো ক্ষেত্রের প্রতি একক ক্ষেত্রফলে কতটুকু বল প্রয়োগ করা হচ্ছে। সংজ্ঞাটা খুব কঠিন। একটু সহজভাবে দেখি।


চাপ মানে হলো বল প্রয়োগের পরিমাণ। একটা ৪ মিটার^২ টেবিলের উপর আমি ১২ নিউটন বলে ঘুসি দিলাম। এখন ঐ টেবিলের প্রতি ১ মিটার^২ কতটুকু বল প্রয়োগ হবে?



৪ মিটার^২ এ বল প্রয়োগ হয় ১২ নিউটন


১ মিটার^২ এ বল প্রয়োগ হয় ১২÷৪ নিউটন


 


আমরা একটু আগেই দেখেছি, প্রতি একক ক্ষেত্রফল বা ১ মিটার^২ এ যতটুকু বল প্রয়োগ করা হয় তাই চাপ। তাই টেবিলে চাপ হবে ১২÷৪ বা ৩ নিউটন। আসলে একটা সমীকরণ কেমন হবে তা পুরোপুরি নির্ভর করে সংজ্ঞার উপর। এখন এই জিনিসটারই বীজগাণিতিক রূপ দেখি,


যদি টেবিলের ক্ষেত্রফল হয় A মিটার^২, আর বল প্রয়োগ করা হয় F পরিমাণ তাহলে চাপ হবে-


A মিটার^২ ক্ষেত্রে বল প্রয়োগ করা হয় F পরিমাণ


১ মিটার^২ ক্ষেত্রে বল প্রয়োগ হবে F÷A  পরিমাণ


তাই চাপ, P=F÷A ।



এখন জানব, প্রবাহী কি। প্রবাহী সম্পর্কে আমাদের সবারই একটা ধারণা আছে, সেটা হলো যা প্রবাহিত হয় তাই প্রবাহী। আর এই যুক্তিতে তরল ও বায়বীয় পদার্থ প্রবাহী। উদাহরণটা ঠিক আছে কিন্তু যুক্তিটা ঠিক নেই। যা প্রবাহিত হয় তাই প্রবাহী, এটা তো একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হলো না। এটা হলো এককথায় প্রকাশ। প্রবাহী কি সেটা আমরা দেখি। আমরা তো জানি তরল একটা প্রবাহী। এখন চিন্তা করো, তোমার কাছে এক গ্লাস পানি আছে। পানিতে  তো অনেকগুলো লেয়ার বা স্তর থাকে (চিত্রঃ ০২)।  যেসব পদার্থের একটা লেয়ারের সাপেক্ষে আরেকটার আপেক্ষিক বেগ থাকে তখন তাদের প্রবাহী বলে। এইজন্য পানি একটা প্রবাহী। একটা লেয়ারের সাপেক্ষে আরেকটার আপেক্ষিক বেগ মানে একটার সাপেক্ষে আরেকটা গতিশীল। যেমন,  রাস্তায় চলা একটা রিকশা আর সিএনজির কথা ভাবো। রাস্তায় যখন রিকশা আর সিএনজি চলে তখন রিকশার তুলনায় সিএনজি দ্রুত এগিয়ে যায়। যার মানে রিকশার সাপেক্ষে সিএনজি গতিশীল। আশা করি, ব্যাপারটা বোঝা গেছে। 

 


এখন আসি প্যাসকেলের ব্যাখ্যায়। প্রবাহী অর্থাৎ তরল ও বায়বীয় পদার্থে চাপ দেয়া নিয়ে প্যাসকেল বলেন-


“একটা আবদ্ধপাত্রে তরল বা গ্যাসীয় পদার্থে বাইরে থেকে চাপ দেওয়া হলে সেটা সবজায়গায় সমানভাবে ছড়িয়ে পড়বে এবং পাত্রের গায়ে চাপটা লম্বভাবে কাজ করবে”

 



খুবই সাদামাটা একটা বাক্য কিন্তু এর মাঝে লুকিয়ে আছে হাইড্রোলিক প্রেসের মতো সুন্দর ভাবনাগুলো। এই বাক্যটা বোঝার জন্য একটা থট এক্সমেরিমেন্ট করতে হবে।



একটা কাঁচের গ্লাসে পানি নিয়ে পানির উপরের পৃষ্ঠে পিস্টন দিয়ে চাপ দিলে কি হবে? দেখুন, চাপ দেয়ার আগে পানির অণুগুলো একটা ভারসাম্য বা সাম্যবস্থায় ছিল। যখন উপর থেকে চাপ দেয়া শুরু হবে, উপরের পানিগুলো অতিরিক্ত একটা বল অনুভব করবে। কারণ চাপ= বল/ক্ষেত্রফল বা প্রতি ১ মিটার^২ ক্ষেত্রে প্রয়োগ হওয়া বল। এই অতিরিক্ত বলের কারণে অণুগুলোর সাম্যবস্থা নষ্ট হবে। তখন তারা আবার সাম্যবস্থায় যেতে চাইবে, তাই ঐ অণুগুলো তাদের চারপাশের অণুগুলোকে বল প্রয়োগ করবে। এভাবে সমানভাবে চাপ সঞ্চালিত হয় বা ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে চাপ দিতে থাকলে এই চাপ ছড়াতে থাকবে, একসময় এই চাপ গ্লাসের গায়ে লেগে থাকা কণাগুলোকে চাপ প্রয়োগ করবে। তখন গ্লাসের গায়ের অণুগুলো লম্বভাবে গ্লাসে চাপ দিবে। আর একসময় গ্লাস সেই চাপ সহ্য করতে না পেরে ভেঙে পড়বে।


 এই অভিজ্ঞতার কথাটাই প্যাসকেল বলেছেন, বৈজ্ঞানিক ভাবে!

 


এখন আবার আসি টরিসেলির পরীক্ষায়। টরিসেলির পরীক্ষায় আমরা দেখেছি, সেখানে শুধুমাত্র ২৪ সে.মি. পারদ অন্য পারদের সাথে মিশতে পারে। কিন্তু ৭৬ সেন্টিমিটার পর্যন্ত পারদ মিশতে পারে না। কিন্তু কেন? তার উত্তর লুকিয়ে আছে প্যাসকেলের ব্যাখ্যায়। তোমরা জানো, পারদ একটা তরল পদার্থ। তাই পারদে চাপ দিলে সেই চাপ সমানভাবে সবজায়গা ছড়িয়ে পড়ে এবং পাত্রের দেয়ালে লম্বালম্বি ভাবে আঘাত করে। কিন্তু পারদকে চাপ দিবে কে? টরিসেলির পরীক্ষায় তো সে পারদকে কোনো পিস্টন দিয়ে চাপ দেন নি, তাহলে চাপ আসবে কোথা থেকে? 


চাপ আসে বায়ুমন্ডল থেকে। আমাদের বায়ুমন্ডলে বিভিন্ন গ্যাসের কণা ছড়িয়ে আছে। তারা বিভিন্ন বেগে আমাদের আশেপাশে ছুটাছুটি করছে। যার কারণে তারা পারদের পাত্রে বল প্রয়োগ করতে পারে। আমরা যেহেতু জনি, চাপ হলো বল প্রয়োগের পরিমাণ। তাই পারদ একটা চাপ অনুভব করবে। এটা আসলে বলের সূত্র থেকেও দেখা যায়, F=ma।  যেহেতু বাতাসের কণার ভর ও ত্বরণ আছে তাই এটা বল প্রয়োগ করতে পারে।  আর এই বলের কারণেই ৭৬ সে.মি. পর্যন্ত পারদকে জাগিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু সেটা কিভাবে হয়? আর এই চাপ আমরা অনুভব করি না কেনো? 


প্রথম প্রশ্নটার উত্তর পাওয়া যাবে, টরিসেলির পরীক্ষার সিস্টেমে। টরিসেলির পরীক্ষায় বড় আকারের পাত্রে বাতাস ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে। ফলে এই চাপ সমানভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বড় পাত্রে বাতাসের চাপ ছড়াতে ছড়াতে সেটা একসময় টেস্টটিউবের প্রান্তে পৌঁছে যায়। ফলে সেই চাপটা পারদকে জাগিয়ে রাখে। যার কারণে ২৪ সে.মি. পারদই বড়ো পাত্রে মিশতে পারে। এখন কথা হলো কেনো বাতাস ৭৬ সে.মি. পারদকে জাগিয়ে রাখে?  এটা বুঝতে হলে তরল পদার্থের ধর্ম "ঘনত্ব" বুঝতে হবে। 


একটা প্রশ্নের উত্তর এখনও দেওয়া হয় নি। বাতাসের চাপ কেন আমরা অনুভব করি না? কারণ আমাদের রক্ত প্রতিনিয়ত আমাদের ত্বকে চাপ দিচ্ছে। যেটা হচ্ছে হৃদপিণ্ডের কারণে। একদিকে বাতাসের চাপ অন্য দিকে রক্তের চাপ কাঁটাকুটি হয়ে যায়। তাই এই চাপ আমরা অনুভব করি না। 


এখন আসি, ঘনত্বের আলোচনায়।




৩. 


সাধারণ আমরা কঠিন পদার্থের পরিমান জানার জন্য ভর মাপি। কিন্তু প্রবাহী অর্থাৎ তরল বা বায়বীয় পদার্থে এটা একটু কঠিন। কারণ তরল বা বায়বীয় পদার্থকে যে পাত্রে রাখা হয় তারা সেই পাত্রের আকার ধারণ করে। যেমন, গ্যাসের কথাই চিন্তা করা যাক। গ্যাসকে যে পাত্রে রাখা হয় সে ঐপাত্রের সম্পূর্ণ  আকার জুড়ে থাকে। এইজন্য গ্যাস বেশি না কম সেটা মাপার জন্য ঘনত্ব অনেক বেশি কার্যকর। ঘনত্বের কারণে দুইটা প্রবাহীকে আলাদা করা যায় খুব সহজে। শুধু এটাই না, প্রবাহী ঘনত্বের পার্থক্যের কারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধর্ম দেখায়। 


এখন একটা থট এক্সপেরিমেন্ট করি। আমার কাছে দুইটা সিলিন্ডার আছে। একটা ১ ঘনমিটারের অন্যটা ৩.৩৭৫ ঘনমিটারের। এখন আমি দুইটা সিলিন্ডারেই ১ কেজি করে নাইট্রোজেন ঢুকালাম। এখন প্রশ্ন দুইটা নাইট্রোজেন ভর্তি সিলিন্ডারে আমি যদি ১০ গ্রামের একটা কাগজ এমনভাবে ফেলি, যাতে বাইরে থেকে নতুন কোনো গ্যাস ঢুকতে না পারে। তাহলে কোন সিলিন্ডারে কাগজ বেশি বাধা অনুভব করবে?


অবশ্যই ১ ঘনমিটার সিলিন্ডারে। কারণ সেখানে সিলিন্ডারে জাগয়া কম। তাই নাইট্রোজেন গাদাগাদি করে অবস্থান করবে। অন্যদিকে দ্বিতীয় সিলিন্ডারে জায়গা বেশি তাই নাইট্রোজেনের অণুগুলো প্রথমটার তুলনায় কম গাদাগাদি করে অবস্থান করবে। তাই প্রথম সিলিন্ডারে বাধা বেশি পাবে। অনেকটা ট্রাফিক জ্যামের মত। 


এই যে পার্থক্য এর কারণ কি? এর কারণ ঘনত্ব। এখন আসি, ঘনত্ব কি। 

ঘনত্ব হলো একক আয়তনে (১ ঘনমিটার) কতটুকু ভর থাকবে তার পরিমাপ। 

উপরের উদাহরণ দেখি,সেখানে প্রথম পাত্রের আয়তন ১ ঘনমিটার। যেহেতু ১ ঘনমিটারে যতটুকু পদার্থ থাকতে পারে তাই ঘনত্ব। তাই প্রথম সিলিন্ডারে ঘনত্ব ১ কেজি প্রতি ঘনমিটার। 

দ্বিতীয় পাত্রের আয়তন ৩.৩৭৫ ঘনমিটার। 

তাই প্রতি  ১ ঘনমিটারে ভর বা পদার্থের পরিমাণ হবে ১÷৩.৩৭৫ = ০.২৯৬ কেজি প্রতি ঘনমিটার। 


এটাকে বীজগাণিতিক ভাবে লিখা যায়।


V আয়তনে প্রবাহীর ভর m   

১ একক আয়তনে প্রবাহীর ভর m÷V


আর এই জন্য ঘনত্ব,  rho = m÷V  



এটাই ঘনত্বের সূত্র। এখন সূত্রটা একটু এনালাইসিস করি।


 ρ=M/V

আমরা জেনেছি,ঘনত্ব মানে প্রতি একক আয়তনে পদার্থের ভর।

আর ভর মানে "কোনো বস্তুতে থাকা মোট পদার্থের পরিমাণ "। 

10m³ একটি ঘরের প্রতি একক আয়তন (1m³) এ 1kg  বায়ু আছে।আমরা যদি ওই ঘরের থাকা বায়ুর ভর বের করতে চাই তবে ওই ঘরে কত পরিমাণ বায়ুর কণা আছে তা বের করতে হবে।


যদি প্রতি একক আয়তনে 1 kg কণা থাকে তবে ওই ঘরে মোট বায়ুর ভর 10 kg।  


আমরা আসলে m=ρv সূত্র থেকে কোনো স্থানে পদার্থের ভর বের করতে পারি। এইটা খুবই কার্যকর একটা সূত্র। এখান থেকে ভর বোঝা যায়। যেমন, একটা বোতলে পানি নিয়ে ঐ সমান আরেকটি বোতলে তরল গুড় নিলে (যেগুলো দিয়ে আচার বানানো হয়!) গুড়ের বোতলটা বেশি ভারী মনে হবে। কেন? কারণ গুড়ের ঘনত্ব বেশি। এতক্ষণ ঘনত্ব নিয়ে আলাপের কারণ এটা বোঝানো যে, ঘনত্ব আর আয়তনের গুণফল থেকে ভর পাওয়া যায়। এটা কঠিন, তরল বা বায়বীয় পদার্থ সবার জন্য সত্যি।



৪. 


আমরা ঘনত্বের আলাপ শুরু করেছিলাম, টরিসেলির এক্সপেরিমেন্টে কেন ৭৬ সে.মি পারদকে বায়ুমন্ডল জাগিয়ে রাখে সেটা জানার জন্য। এখন আমরা আস্তে আস্তে সেই দিকে আগাবো। 


তার আগে প্রশ্ন,একটা পাত্রে পানি বা তরল পদার্থ নিলে সে ওই পাত্রে কি পরিমাণ চাপ দিবে?

আমরা দেখেছি, চাপ: P=F/A. কোনো পাত্রে 2kg পানি নিলে আর তার ক্ষেত্রফল 0.4 m² হলে আমরা চাপ বের করতে পারি।


পানি যে বল দিবে তা হলো F=mg যা পানির ওজন।

m পানির ভর,2 kg আর g মহাকর্ষীয় ত্বরণ 9.8

তাই F=19.6 N 

এবার চাপ হলো

 P=F/A

    =19.6/0.4

    =49N


আচ্ছা এবার দেখুন,পাত্রের তলায় তো পানি F=mg বল দিচ্ছে,আবার,আমরা দেখেছি m=ρv তাই লিখতে পারি 

F=mg

  =ρVg 

V হলো আয়তন,আমরা জানি আয়তন = ক্ষেত্রফল×উচ্চতা 

V=Ah

∴F=Ahρg 

এবার এটা চাপের সূত্রে বসাই

 P=F/A

 P=Ahρg/A

 P=hρg


এবার P=hρg এই সূত্রটা কতটুকু কার্যকর তা দেখি।

চিত্র ০৩ এ একটি সুষম পাত্র দেখানো হয়েছে যার উপরে এবং তলায় ক্ষেত্রফল একই। কিন্তু চিত্র ০৪ এ একটা কোণকের ফ্রাস্টাম যার উপরের আর তলার ক্ষেত্রফল একই না।


এজন্য চিত্র ০৪ অর্থাৎ সুষম পাত্রে পানি বল প্রয়োগ করবে Ahρg পরিমাণ।

কারণ এতে h সংখ্যক A আছে। A মানে প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল।  সুষম পাত্রকে ভুমির সমান্তরালে কাটলে সবসময় একই ক্ষেত্রফল পাওয়া যাবে। যা হলো A।

সুতরাং চাপ,

 P=Ahρg/A

   =hρg


কিন্তু যেহেতু চিত্র ০৪ নং এর পাত্র সুষম না তাই এর আয়তন V কে Ah বলা যাবেনা, কারণ এতে h সংখ্যক A নেই। বা প্রতিবার ভুমির সমান্তরালে কাটলে একই ক্ষেত্রফল পাওয়া যাবে না। 

ফলে এর চাপ হবে,P=vρg/A

অর্থাৎ এখানে আমরা V কে ভেঙে Ah লিখতে পারিনি। 



টরিসলির পরিক্ষা ও বায়ুমন্ডলের চাপ :


এবার টরিসেলির এক্সপেরিমেন্টে আবার ফিরি।টরিসলির পরিক্ষায় একটা পারদ ভর্তি পাত্রে আরেকটা পারদ ভর্তি টেস্টিউব লম্বভাবে বসানো হয়।আর বাতাসের চাপের কারণে সেটা 76 পর্যন্ত উঠে থাকে।এই চাপকে 1 atm বা বাতাসের স্বাভাবিক চাপ বলা হয়। এখন আমরা দেখব 1atm সমান কত প্যাসকেল।


টরিসলি যে পাত্র ব্যাবহার করেছিল সেটা ছিল সুষম।তাই এর চাপ P=hρg ( এখানে ঘনত্ব হবে পারদের ঘনত্ব) 

মান বসিয়ে, P=0.76×13000×9.8

    =101292.8 N 

 ∴1 atm = 1.012 × 10⁵ pascal 


এখন তো আমরা পেয়ে গেলাম বাতাস কত প্যাসকেল চাপ দেয়। এখান থেকে এই চাপ কতটুকু পারদকে জাগিয়ে রাখতে পারবে।

বাতাস তো পাত্রে সবসময় চাপ দিচ্ছি। যখন টেস্টটিউব পাত্রে ডুবানো হয় তখন পারদ একটা ছিদ্র পেয়ে যায়। ফলে পারদ ঐ ছিদ্রে প্রবেশ করে। ঐ ছিদ্র দিয়ে প্রবেশের পর কতটুকু উচ্চতা পর্যন্ত পারদ উপরে উঠবে তা সূত্র থেকে দেখা যায়,

  P= hρg

=> h=P/ρg 

যেহেতু আমরা একটু আগেই বাতাসের চাপ কত প্যাসকেল সেটা মেপেছি এখন সেই মান বসালে আমরা পাব ০.৭৬ মিটার বা ৭৬ মিটার। টরিসেলির এই পরীক্ষা এত দারুণ যে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ব্যারোমিটারে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। আমরা চাইলে পারদস্তম্বের ওঠা নামা দেখে বাতাসের চাপ মেপে ফেলতে পারব খুব সহজে। 


এখন শেষ একটা প্রশ্ন, টরিসেলি কেন পারদ ব্যবহার করলেন? 


এটার উত্তর পাব আরেকটা প্রশ্ন থেকে। 

টরিসলির পরিক্ষায় পারদের পরিবর্তে পানি ব্যবহার করলে কি হতো?


টরিসলির পরিক্ষায় পারদের জায়গায় পানি ব্যবহার করলে কিন্তু পরিবর্তন আনতে হবে।নলটা হতে হবে ১১ মি. বাকি সব একই থাকবে। (চিত্রঃ ০৫)

যেহেতু চাপ 1 atm তাই

P= hρg

=>h=P/ρg

=101292.8/1000×9.8

=10.336 m.


যেখানে পানি ওঠে ১০.৩৩৬ মিটার পারদ উঠে ০.৭৬ মিটার। আমরা যদি নলটা ১১ মিটার না নিয়ে ১৩ মিটারও নিতাম পানি ১০.৩৩৬ মিটার পর্যন্তই উঠতো। 

পানি উঠে 10.336 মিটার পারদ উঠে 0.76 মিটার কেনো?

কারণ, একই বায়ুমন্ডলিয় চাপে,

h∝1/ρ


পদার্থের ঘনত্ব যত কম হবে বস্তু তত উপরে উঠবে। পদার্থের ঘনত্ব যত বেশি হবে বস্তু তত কম উপরে উঠবে,কারণ ঘনত্ব বাড়া মানে ভর বাড়া।ভারি হওয়া।


টরিসেলি পারদ নিয়েছিলেন কারণ পারদ ভারী তরল। যদি পাতলা তরল নিতেন তাহলে ল্যাবে ১১ মিটার লম্বা (পানির ক্ষেত্রে) টেস্টটিউব আনতে হতো! যা অনেক কষ্টকর ও ব্যয়বহুল। 


টরিসেলি এই অদ্ভুত সুন্দর পরীক্ষাটি করে কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেন নি। যার nব্যাখ্যা পরবর্তীতে দিয়েছেন প্যাসকেল! 


এখন কি মনে হয়, 

"আমরা প্রকৃতিকে যেভাবে দেখি সে ঐভাবেই কাজ করে, নাকি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভুল?"


Oyahidur Rahman Mohin

I am Mohin. Reading, writing and thinking are my passion. I usually write fiction and non-fiction for pleasure. And I am trying to touch the tune of life. "Life is really very simple but we insist on making it complicated."

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম