যুক্তি-চিন্তায় রসায়নঃ মোল ও সংকেত

 



আমাদের চারপাশের পরিবেশ আর রাসায়নিক উপাদান নিয়ে আমাদের কৌতুহল বহুকালের৷ আমাদের পরিবেশ, গাছ, পাহাড় এগুলো কী দিয়ে তৈরি? এই প্রশ্ন সবসময় ভাবিয়েছে দার্শনিকদের। চিন্তা করো আজ থেকে ৭০০০ বছর আগে যখন মানুষ বৃষ্টি দেখত, তখন তারা কী ভাবত? তারা হয়তো ভাবত বৃষ্টি একটা অভিশাপ। যা সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়। হয়তো ভাবত, বৃষ্টি একটা আশির্বাদ। এর কারণে গাছপালা বেড়ে ওঠে, আর তারা খাবার পায়। কিংবা এটাও ভাবত যে, আমরা যেখানে অনস্থান করছি, সেটা হলো দুই সমুদ্রের মাঝামাঝি কোনো অবস্থান। কারণ মাটি খুঁড়লেই পানি পাওয়া যায়, আবার বৃষ্টি হলে আকাশ থেকে পানি পড়ে ৷ আর এই জন্য হয়তো এরিস্টটল ভাবতেন প্রকৃতির সবকিছু চারটি জিনিস দিয়ে তৈরি। মাটি, পানি, বায়ু ও আগুন। 



পদার্থ যে অণু-পরমাণু দিয়ে তৈরি, এই আবিষ্কারটা ছিল মানুষের বৈপ্লবিক আবিষ্কার। রিচার্ড ফাইনম্যান তাঁর ‘The Fynmen Lecture on Physics’ বইয়ে একটা থট এক্সপেরিমেন্টের কথা বলেন। আমি ‘সিক্স ইজি পিসেস’ বইয়ে উচ্ছ্বাস তৌসিফ ভাইয়ের অনুবাদ তুলে দিলাম—


“ যদি কোনো প্রলয়ঙ্কারী ঘটনা আমাদের সকল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ধ্বংস করে দেয় এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কেবল একটি বাক্য পৌছে দেওয়ার সুযোগ থাকে, তাহলে কোন বাক্যে সবচেয়ে কম শব্দে সবচেয়ে বেশি তথ্য পৌছে দেওয়া যাবে? আমি বিশ্বাস করি, এটা পারমাণবিক হাইপোথিসিস (ধ্রুব সত্যও বলতে পারেন): সবকিছু পরমাণু দিয়ে তৈরি, এরা এমন ক্ষুদ্রতম কণা যা অবিরাম ছুটোছুটি করে, দূরে থাকলে একে অন্যকে আকর্ষণ করে, এবং একটু ছোঁয়া পেলে পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। ”


এই বাক্যের যৌক্তিকতা একটু ইতিহাস ঘাটলেই বোঝা যাবে৷ খ্রিষ্টপূর্ব (যিশু খ্রিষ্টের জন্মের আগে) ৭০০ অব্দে ডেমোক্রিটাস পরমাণুর ধারণা দেন। আস্তে আস্তে এই ধারণার উত্থান-পতন ঘটে। আর সর্বশেষে ১৯০৫ সালে আইন্সটাইন প্রমাণ করেন পরমাণু সত্যি সত্যি আছে৷ এই একটা সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রায় ২০০০ বছর লেগেছে! 


এতক্ষণ এত জল্পনা-কল্পনার কারণ এটা বোঝানো যে মানুষ কত কৌতুহলী। সে জানে যে তার একজীবনে পুরো জ্ঞান ধারণ করতে পারবে না, তবুও সে ভাবে। আনন্দের জন্য, পৃথিবীর জন্য। 



১.

এখন একটা জিনিস চিন্তা করো, রসায়নবিদরা যদি একটা মৌলের সাথে অন্য মৌলের বিক্রিয়া ঘটাতে চায়, তাহলে সেটা কীভাবে করবে? মনে করো তুমি এখন ল্যাবে আছো। তুমি হাইড্রোজেন (H) আর অক্সিজেনের (O) বিক্রিয়া ঘটাতে চাও। তুমি কীভাবে কাজ করবে? অবশ্যই এমন একটা পরিমাণ নিতে হবে যেটা তুমি অনুভব করতে পারো। এখন তুমি যদি H আর O এর প্রকৃত ভর নিয়ে কাজ করতে চাও, সেটা কি সম্ভব? না, কারণ H এর প্রকৃত ভর 1.66 × 10⁻²⁴ গ্রাম। কী, বুঝতে পারছ কত ছোটো সংখ্যা! এটা নিয়ে কাজ করতে গেলে আমাদের কোনো অনুভূতিই কাজ করবে না। আর এইজন্যই রসায়নবিদরা প্র‍্যাকটিক্যালি কাজ করার জন্য ‘মোল' নামে একটা ধারণার জন্ম দিলেন। কী এই মোল, তা জানার আগে একটু জেনে আসি, আণবিক ভর কী বা পারমাণবিক ভর কী।


২.

একটু আগেই আমরা দেখেছি H এর প্রকৃত ভর কত ছোটো৷ আসলে এত ছোটো ভর দেখে কোনো মৌলকেই সহজে বোঝা সম্ভব না তারা কতটুকু ভারী৷ এটা বুঝতে হলে অনেক গাণিতিক কসরত করতে হবে। তাই কোন মৌল কতটুক ভারী, তা সহজে বোঝার জন্য এবং তাদের নিয়ে কাজ করার জন্যে IUPAC মানে International Union of Pure and Applied Chemistry তিনটা স্কেল নির্ধারণ করে—

১. হাইড্রোজেন স্কেল 

২. অক্সিজেন স্কেল

৩. কার্বন স্কেল


১৯৬১ সাল থেকে পারমাণবিক বা আণবিক ভর মাপতে C স্কেল ব্যবহার করা হয়৷ 

এখন দেখি কার্বন স্কেলে কীভাবে ভর মাপা হয়। 


C স্কেলে পারমাণবিক ভর = কোনো মৌলের ১টি পরমাণুর ভর ÷ (C-12) আইসোটোপের ভরের ১/১২ অংশ 

এই স্কেলে তাকালে দেখা যাবে এখানে একটা ভাগের সম্পর্ক আছে। যেটা দিয়ে বোঝা যায় কত গুণ। এই স্কেলে আইসোটপের ধারণা একটু বিভ্রান্তিতে ফেলতে পারে। 

আইসোটোপের ধারণাটা খুবই সহজ। আমরা আমাদের চারপাশে নরমাল মানুষের পাশাপাশি কিছু বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু দেখি (তাই বলে তারা দুর্বল নয়, আমরা সবাই নিজের জায়গায় অনন্য)। আইসোটোপও অমন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন পরমাণু। কিন্তু এদের একটা নির্দিষ্ট চাহিদা আছে৷ সেটা হলো ভরসংখ্যায় [প্রোটন সংখ্যা + নিউট্রন সংখ্যা = ভর সংখ্যা]। 

যেহেতু আমরা জানি, প্রোটন সংখ্যা সবসময় ইলেক্ট্রন সংখ্যার সমান, তাই ভরসংখ্যায় পার্থক্য মানে নিউট্রন সংখ্যায় পার্থক্য৷ আইসোটোপের প্রোটন সংখ্যা একই থাকে, ভর সংখ্যা আলাদা হয় বা নিউট্রন সংখ্যা আলাদা৷ 


এখন আসি পারমাণবিক ভরে৷ পারমাণবিক ভরকে তুলনা করা যায় দাঁড়িপাল্লার সাথে৷ দাঁড়িপাল্লায় যখন আমরা কিছু মাপ দিই, তখন একটা বাটখারাকে আদর্শ ধরে নিই। সেটা হতে পারে ১ কেজি, ২ কেজি, ৫০০ গ্রাম। পারমাণবিক ভরও দাঁড়িপাল্লার মতো। এখানে আদর্শ ধরা হয় C-12 আইসোটোপের ১/১২ অংশকে। মনে করো, আমি H এর ভর মাপব। এখন আমি একপাশে C-12 এর ১/১২ অংশ নেব, অপরপাশে H নেব৷ দেখা যাবে, H এর ভর কার্বন ১২ আইসোটোপের প্রায় সমান। তাই H এর ভর 1 । এখন যদি Na এর ভর বা কতটুকু ভারী তা মাপতে চাই, তাহলে H কে সরিয়ে Na দেবো৷ দেখা যাবে, C-12 এর ১/১২ অংশের তুলনায় Na অনেক ভারী। কতটুক ভারী, তা বোঝার জন্য ২টা ১/১২ অংশ নিই (মনে করো C-12 এর ১/১২ অংশ একটা পাথর বা বাটখারার মতো)। এভাবে ২৩টা ১/১২ অংশ নিলে Na হবে। 

তাহলে Na , C-12 এর ১/১২ অংশের তুলনায় ২৩গুণ ভারী৷ এখন এই ভর দেখে সহজে বোঝা যায়, Na, H বা অন্য মৌলগুলো কতটুকু ভারী৷ 


এখন প্রশ্ন আসতে পারে, C-12 এর ১/১২ অংশের প্রকৃত ভর কতটুকু?

C-12 এর ১/১২ অংশের প্রকৃত ভর 1.66 × 10⁻²⁴ গ্রাম৷ এটা মাপা হয়েছে ভর বিক্ষেপন পরীক্ষার মাধ্যমে। তাছাড়া, এটা তাত্ত্বিকভাবেও মাপা যায়, যেহেতু H আর C-12 এর ১/১২ অংশ সমান৷ তাহলে H এর ভরই হবে C-12 এর ১/১২ অংশ। H এর একটা পরমাণুতে ১টা প্রোটন আর ১টা ইলেক্ট্রন আছে৷ দেখো তো, এখান থেকে মান বের করতে পারো কি না!


পারমাণবিক ভর কী, সেটা তো বুঝলে, এখন দেখি আণবিক ভর কী। 

আণবিক ভর হলো C-12 এর ১/১২ অংশের তুলনায় কোনো অণু কতগুণ ভারী৷ যেমন: H₂O বা পানির আণবিক ভর কত হবে? 

পানি যেহেতু ২টা H ও ১টা O দিয়ে তৈরি, তাই ২টা H ও ১টা O দিয়ে তৈরি তাই ২টা H ও ১টা O এর মিলিত ভর হবে পানির আণবিক ভর৷ 

.'. H₂O এর আণবিক ভর = (1×2)+16

                                    =18


মানে H₂O, C-12 এর ১/১২ থেকে ১৮গুণ ভারী৷ একটা বিষয় খেয়াল করো, আণবিক বা পারমাণবিক ভরের কিন্তু কোনো একক নেই। বলো তো কেন? কারণ এরা হলো অনুপাত। অনুপাত দিয়ে আসলে কতগুণ সেটা বোঝায়। এখানে হরের আর লবের একক কাটাকুটি হয়ে যায়। 



৩.

এতক্ষণ আমরা ইতিহাস দেখেছি৷ আর কিছু প্রাথমিক আলোচনা করেছি৷ এবার মূল আলোচনায় ঢুকব। আমাদের আলোচনা ‘মোল' আর ‘রাসায়নিক সংকেত’ নিয়ে। 

মোল কী? মোল আসলে একটা সংখ্যা বা একটা পরিমাপের একক। বাজারে আমরা ডিম কেনার বেলায় বলি না—১ হালি ডিম দেন; যেটা একটা এমাউন্ট নির্দেশ করে৷ মোলও তেমনি একটা একক যেটা একটা নাম্বার বা এমাউন্টকে নির্দেশ করে। 


মোল কীভাবে অনুভব করা যায়, সেটা দেখি।


“১২ গ্রাম C-12 আইসোটোপে যতগুলো পরমাণু আছে, তত সংখ্যক যে-কোনো কিছুকে (যা গোনা যায়, যেমন: পরমাণু, কলম, মানুষ) ওই পদার্থের ১ মোল বলে।” 


ওপরের বাক্যটা হলো মোলকে সেন্স করার একটা উপায়। এটাকে মোলের স্বীকৃত সংজ্ঞা বলা যায় না। কেন সেটা একটু পরেই দেখব।


তাহলে বাক্যটা খেয়াল করো। আমি সেখানে কিছু কৌশল খাটিয়েছি। যেমন আমি 12 g C-12 নিয়েছি। কিন্তু কেন 12g, কেন C-12 আর কেন-ই বা ‘গ্রাম’ একক?

প্রথমে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিই।

 C এর অনেকগুলো আইসোটোপের মধ্যে C-12 কে নেওয়ার কারণ এটা প্রকৃতিতে সহজে এবং সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়৷ আর এই কারণেই পারমাণবিক ভর বের করতে C-12 ব্যবহার করা হয়। 


মোল সম্পর্কে বলার আগেই আমি বলেছি মোল একটা সংখ্যা। সংখ্যাটা কী, সেটা আমি বলিনি। ধরে নাও, সংখ্যাটা কী আমি জানি না। তাই প্রাকটিকালি কাজ করার জন্যে ‘মোল' কীভাবে ব্যবহার করব তা পাব সংজ্ঞা থেকে। 


দেখো, 12 g C-12 তে যদি x-টা পরমাণু থাকে তাহলে x-টা পরমাণুর ভর 12 g । 

এখন, C-12 আর H এর পারমাণবিক ভরের মাঝে তুলনা করি। 

[ চিত্র: C ও H এর ভরের তুলনা ]


আমরা শুরুতে দেখেছি C-12 পরমাণুর ভর 12 g  (C-12 এর 1/12 এর তুলনায় 12 গুণ ভারী)। 

H এর ভর 1 (C-12 এর 1/12 এর সমান)।


তাহলে একটা H, একটা C-12 এর তুলনায় কত গুণ ভারী? 

1/12 বা 12 ভাগের 1 ভাগ৷ 


2টা H, 2 টা C-12 এর তুলনায় কতগুণ ভারী? 

12 ভাগের 1 ভাগ৷ কারণ লব আর হরে একই সংখ্যা মানে 2 গুণ হয়েছে। ফলে 2 কাটাকাটি গেছে৷ 

এমন করে যদি x-টা বা 1 মোল H, x-টা বা 1 মোল C-12 এর তুলনায় কতগুণ ভারী.

12 ভাগের 1 ভাগ। 


এখন মজাটা দেখো, আমি কিন্তু বলে দিয়েছি x-টা বা 1 মোল C-12 এর প্রকৃত ভর 12 g । 

তাহলে 1 মোল H এর প্রকৃত ভর কত? 1g!

 

একই যুক্তিতে Na এর 1 মোল 23 g । কারণ 1টা Na, 1টা H এর তুলনায় 23গুণ ভারী। 

তাহলে মোল জিনিসটা কী?


“মোল হলো কোনো মৌলের বা যৌগের আণবিক ভরের গ্রাম এককে প্রকাশ।” 

এটা হলো মোলের স্বীকৃত সংজ্ঞা। 


এখন প্রশ্ন হলো এই সহজ কথাটা আমি এত পেঁচিয়ে বললাম কেন? সেটা বুঝতে হলে মোলের স্বীকৃত সংজ্ঞায় ফেরত যেতে হবে। মোল যেহেতু কোনো মৌল বা যৌগের ভরের গ্রাম এককে প্রকাশ, তাহলে তো 16g O এ যে পরিমাণ পরমাণু থাকবে, সেটাই মোল। 

তার মানে কি 16 g O, 12 g C, 23 g Na তে একই সংখ্যক পরমাণু আছে? (যেহেতু মোল একটা সংখ্যা!)

হ্যাঁ, একই সংখ্যক পরমাণু থাকে। যেটা হলো 6.023 × 10²³ । আর এই জিনিসটা বোঝানোর জন্যই এতো প্যাঁচাল পাড়লাম। এখন আশা করি প্রথম প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছো। 12 গ্রাম ধরার কারণ কার্বনের আণবিক ভর 12! যেখানে 6.023 × 10²³ টা পরমাণু আছে। এই সংখ্যাটা আবিষ্কার হয় ১৯০৮ সালে৷ আর ১৯০৮ সালের আগে মানুষ শুধু এটাই জানত যে এই একই সংখ্যার হয়। কিন্তু কেন হয়? সেই ব্যাখ্যাটা তোমরাই ভাবো। ( ক্লুঃ আদর্শ গ্যাসে বয়েল আর চার্লসের সূত্র)


6.023 × 10²³ সংখ্যাটাকে বলা হয় অ্যাভোগাড্রো সংখ্যা। কারণ মোলের সর্বপ্রথম ধারণা দেন অ্যাভোগাড্রো। এই সংখ্যাটা নির্ণয় করেন বিজ্ঞানী পেরিন।


এই অংশটুকু শেষ করব শেষ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে। কেন "গ্রাম" একক। চিন্তা কর, যদি গ্রামের জায়গায় কেজি হতো। তাহলে এক মোল লবণ নিয়ে কাজ করতে গেলে ল্যাবে 58.5 কেজি লবণ নিয়ে আসতে হতো! প্রায় লবণের বস্তা আনা লাগত। আর যদি মিলিগ্রাম নেয়া হতো তাহলে মাপে সমস্যা হতো। কারণ মানুষের তৈরি কোনো যন্ত্রই অ্যাকুরেট না। তাই আদর্শ হিসেবে গ্রামকে একক ধরা হয়েছে। আশা করি, মোলের বিষয়টা সবাইকে আনন্দ দিবে। আর বিজ্ঞানীরা কীভাবে লজিক ব্যবহার করতেন সেটাও বুঝা যাবে। যেই যেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া হয়নি, সেটা নিজেরা বের করার চেষ্টা করবে কিন্তু! 




৪.


রাসায়নিক সংকেত জিনিসটা কী, সেটা আমরা সবাই জানি। রাসায়নিক সংকেত হলো একটা যৌগের পরিচয়৷ কোনো যৌগে (অণুতে) মৌলগুলো (পরমাণু) কীভাবে সজানো থাকে সেটা বোঝা যায় রাসায়নিক সংকেত দিয়ে৷ কিন্তু একটা রাসায়নিক সংকেত কীভাবে আসে, কীভাবে সংকেত থেকে যৌগকে বোঝা যায়, এখন হবে সেই আলোচনা। 


রাসায়নিক সংকেত বোঝার আগে বুঝতে হবে অণু কী। আণু সম্পর্কে আমাদের একটা ধারণা আছে, সেটা হলো এরা পরমাণু দিয়ে তৈরি। অ্যাভোগাড্রো বলেছেন—

“অণু হচ্ছে সেই রাসায়নিক সত্তা, যেটা একটা বস্তুর বৈশিষ্ট্য ধারণ করবে এবং প্রকৃতিতে মুক্তভাবে বিরাজ করবে।”

আসলেই কি সব অণু প্রকৃতিতে মুক্তভাবে থাকতে পারে?

না, সব অণু প্রকৃতিতে মুক্তভাবে থাকতে পারে না। এই যে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, কেন ঘটে? 

কারণ সবকিছু সাম্যাবস্থায় আসতে চায়৷ দুইটা পরমাণুর কথা ভাবা যাক। সোডিয়াম (Na) ও ক্লোরিন (Cl) পরমাণু৷ 


Na এর শেষ কক্ষপথে 1টা ইলেক্ট্রন থাকে আর Cl এর শেষ কক্ষপথে ৭টা ইলেক্ট্রন থাকে। অষ্টক নিয়ম নামে একটা নীতি আছে। এইটা অনুসারে Na ও Cl এর শেষ কক্ষপথে ৮টা ইলেক্ট্রন হলে তারা স্থিতিশীল হয়। আর সেই জন্য Na ও Cl ইলেক্ট্রন আদান-প্রদান করে বিক্রিয়া করে NaCl উৎপন্ন করে৷ যেখানে Na ⁺ ও Cl⁻ আয়ন আছে। Na তার একটা ইলেক্ট্রন ত্যাগ করে আর Cl ওই একটা ইলেক্ট্রন গ্রহণ করে একটা বন্ধন তৈরি করে৷ যেটাকে বলে আয়নিক বন্ধন৷ আর যেসব যৌগে আনবিক বন্ধন থাকে, তারা হলো আয়নিক যৌগ। আয়নিক কারণ এখানে দুইটা আয়ন থাকে, একটা পজিটিভ (Na ⁺) অন্যটা নেগেটিভ (Cl⁻)  ।

এই বন্ধনগুলো বিপরীত আয়নের হওয়ায় এদের মধ্যে অনেক শক্তিশালী স্থির বৈদ্যুতিক আকর্ষণ থাকে। এই আকর্ষণগুলো এত বেশি হয় যে একটা NaCl অণু মুক্তভাবে প্রকৃতিতে থাকতে পারে না।তারা অনেকগুলো অণু একত্রে ক্রিস্টাল গঠন করে মুক্তভাবে বিরাজ করে। 


যেমন: আমরা সবাই লবণের কণা দেখি, এটাই NaCl বা সোডিয়াম ক্লোরাইড। 

এছাড়াও অনেক যৌগ আছে যারা ক্রিস্টাল গঠন না করেই প্রকৃতিতে আলাদাভাবে থাকতে পারে৷ যেমন, পানির অণু বা H₂O । এখানে ২টা হাইড্রোজেন ১টা অক্সিজেনের সাথে যুক্ত হয়ে অণু গঠন করে, আর এই অণু প্রকৃতিতে মুক্তভাবে থাকতে পারে৷ তার জন্য ক্রিস্টাল গঠন করতে হয় না। একটা কথা বলে রাখি, আয়নিক বন্ধন হয় ধাতু আর অধাতুর মিলনে। আর সমযোজী বন্ধন (ওপরের পানির অণুর বন্ধন) হয় অধাতু আর অধাতুর সাথে৷ 


যেহেতু এক ধরণের যৌগ প্রকৃতিতে মুক্তভাবে থাকে, আরেক ধরণের যৌগ ক্রিস্টাল গঠন করে থাকে, তাই এই দুই ধরণের যৌগের পরিচয় প্রকাশ করার জন্য দুই ধরণের রাসায়নিক সংকেত দরকার৷ আর এই জন্য রাসায়নিক সংকেত দুই ধরণের হয়:—

১. স্থুল সংকেত

২. আনবিক সংকেত 

এখন দেখি, কেন দুই ধরণের যৌগের জন্য দুই ধরণের সংকেত প্রয়োজন। 

সংকেত দিয়ে আসলে কী বোঝায়? কোনো যৌগের পরিচয়। আমার কাছে একটা যৌগ আছে, আমি যদি ওই যৌগে কী কী মৌল কীভাবে আছে সেটা প্রতীক দিয়ে বোঝাতে পারি, সেটা হবে সংকেত। 

এবার যেসব যৌগ ক্রিস্টাল আকারে থাকে, মানে আয়নিক যৌগ তাদেরকে নিয়ে এনালাইসিস করি৷ 


তুমি একটু চিন্তা করো, একটা Na আর একটা Cl মিলে লবণ বা NaCl তৈরি হয়৷ আমি NaCl বা লবণের একটা কণা নিলাম। এখন আমি কোনোভাবে জানতে পারলাম সেখানে 100টা Na আছে। তাহলে আমি বলতে পারি সেখানে 100টা Cl পরমাণুও আছে৷ কারণ 1টা Na ও 1টা Cl মিলে NaCl হয়। 


এখন আমি যদি আরেকটা বড়ো লবণের ক্রিস্টাল নিই, সেখানে যদি 200টা Na থাকে তাহলে অবশ্যই 200টা Cl থাকবে৷ 




দেখেছ, আয়নিক যৌগের ক্ষেত্রে প্রকৃত আয়নের সংখ্যাটা নির্ভর করছে ক্রিস্টালের ওপর৷ ক্রিস্টাল যত বড়ো, আয়ন তত বেশি। যেহেতু NaCl এর সংখ্যা জানতে “ক্রিস্টাল” একটা বড়ো ফ্যাক্টর, তাই এই সমস্যা থেকে মুক্তির একটা পথ খুঁজলেন বিজ্ঞানীরা। কারণ যতবারই সংখ্যা জানার ইচ্ছা হবে, সবার আগে জানতে হবে ক্রিস্টালের সাইজ। তাই বিজ্ঞানীরা প্রকৃত সংখ্যাটা না জানার চেষ্টা করে যৌগের মধ্যে বা অণুর মধ্যে পরমাণু কতগুলো কত গুণ হিসেবে আছে সেটা জানার চেষ্টা করলেন। আর এটাই হলো স্থুল সংকেত৷ যেমন, সোডিয়াম ক্লোরাইডে যতটা Na থাকবে, ঠিক ততটাই Cl থাকবে৷ 

তাই তাদের অনুপাত, Na : Cl = 1 : 1 

। আএ এই জন্যই NaCl । 

যদি Na : Cl = 2 : 1 হতো, তাহলে Na₂Cl হতো৷ এখন বোঝা গেছে স্থুল সংকেত কী? স্থুল সংকেত হলো পরমাণুগুলো কত অনুপাতে আছে, তার হিসাব৷ 


এবার আসা যাক আণবিক সংকেতে। আণবিক সংকেত দিয়ে অণুতে বিদ্যমান পরমাণুগুলোর প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ করে৷ তাই এটা বিশেষ ভাবে ওই সব যৌগের জন্য যারা অণু গঠন করে মুক্তভাবে থাকতে পারে৷ মানে সমযোজী যৌগের জন্যে৷ যেহেতু সমযোজী যৌগ মুক্তভাবে বিরাজ করতে পারে, সেক্ষেত্রে প্রতি অণুতে পরমাণুগুলো কত সংখ্যক আছে তা বোঝা যায়। যেই কাজটা আনবিক সংকেত।


আমরা তো বুঝলাম স্থুল সংকেত কী আর আনবিক সংকেত কী।

স্থুল মানে তো পরমাণুর অনুপাত। এটা কি শুধু ক্রিস্টাল গঠন করে যারা তাদের জন্য প্রযোজ্য?

না। স্থুল সংকেত সবার জন্য প্রযোজ্য। একটা উদাহরণ দেখি, CO₂ ও C₂H₆ নিয়ে৷ 


(চিত্র দ্রষ্টব্য) 

CO₂ তে কার্বন সংখ্যা 1 এবং অক্সিজেন সংখ্যা 2। যেহেতু CO₂ সমযোজী যৌগের অণু গঠন করে, এর আণবিক সংকেত CO₂। আমি চাইলে তো এখান থেকে স্থুল সংকেত বের করতে পারি৷ সেটা হবে, 

Number of Carbon, n(C) : Number of Oxygen, n(O) = 1 : 2


.'. স্থুল সংকেত CO₂  । 

C₂H₆ ও একটা সমযোজী যৌগ৷ যেহেতু এটা অণু গঠন করে, তার আণবিক সংকেত থাকবে৷ এছাড়াও স্থুল সংকেতও থাকবে। যেহেতু স্থুল সংকেত মানে অনুপাত৷ 

C₂H₆ এ,  

n(C) / n(H) = 2/6 = ⅓ 

n(C) : n(H) = 1 : 3 

.'. C₂H₆ এর স্থুল সংকেত CH₃ 

আর মানে, স্থুল সংকেত বানানো হয় আয়নিক যৌগের জন্য৷ কিন্তু এটা সব যৌগের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আর আণবিক সংকেত শুধুমাত্র যারা অণু গঠন করে তাদের জন্য প্রযোজ্য। 

[চিত্র:আণবিক সংকেত ও স্থুল সংকেত ]


এখন, একটা বিষয় খেয়াল করো৷ 

স্থুল সংকেতের সাথে একটা পূর্ণসংখ্যা গুণ হয়ে আণবিক সংকেত তৈরি করে৷ আর এই জন্য কোনো যৌগের আণবিক সংকেত বের করতে স্থুল সংকেত লাগবে৷ 

যেহেতু স্থুল সংকেত × x = আণবিক সংকেত, 

যেখানে x পূর্ণসংখ্যা৷ 

তাহলে স্থুল সংকেত থেকে যে ভরটা পাব, সেটার সাথে আরেকটা সংখ্যা গুণ হয়ে আণবিক ভর পাওয়া যাবে৷ 

যেমন,  CO₂ এর স্থুল সংকেত ও আণবিক সংকেত একই৷ 

স্থুল সংকেত (CO₂)₁ = আণবিক সংকেত CO₂ 

তাহলে, C₂H₆ এর ক্ষেত্রে,

স্থুল সংকেত, (CH₃)₂ = আণবিক সংকেত C₂H₆ 


স্থুল সংকেতের ভর × 2 = আণবিক সংকেতের ভর 

(12+3)×2  =  (12×2)+6 

30  =  30 


বুঝেছ ব্যাপারটা? যদি বুঝে থাক, তাহলে এটাও বুঝবে, 


আণবিক সংকেত ÷ স্থুল সংকেত = x 


আণবিক সংকেতের যৌগের ভর ÷ স্থুল সংকেতের যৌগের ভর = x 


আণবিক সংকেতের ভর সব সময় স্থুল সংকেতের ভরের চেয়ে বেশি হবে। কেন? 

সেই উত্তর আসা করি তোমরা বুঝতে পেরেছ। 



৫.


এতক্ষণ স্থুল সংকেত আর আণবিক সংকেত নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে৷ এবার আমরা একটা প্র‍্যাক্টিক্যাল সমস্যা দেখি। 


প্রশ্ন: কোনো একটা যৌগ C ও H দিয়ে তৈরি। C ও H এর শতকরা সংযুতি যথাক্রমে 92.31% ও 7.69% । যৌগের আণবিক ভর 78 হলে আণবিক সংকেত নির্ণয় করো।


প্রশ্নে যে যৌগের কথা বলা হয়েছে সেটা C ও H দিয়ে তৈরি এবং তাদের শতকরা সংযুতিও দেওয়া আছে৷ একটা যৌগের 100 গ্রামে যৌগটির কোনো মৌল যত গ্রাম থাকে, সেটা হয় ওই মৌলের শতকরা সংযুতি। 

প্রশ্নে যেহেতু আণবিক ভর দেওয়া আছে তার মানে এই যৌগ অণু গঠন করে। তাই আণবিক সংকেত বের করার জন্য দরকার স্থুল সংকেত৷ কারণ স্থুল সংকেত × x = আণবিক সংকেত। 

তাই প্রথমে আমাদের স্থুল সংকেত বের করতে হবে। তারপর x বের করতে হবে৷ যেটা বের করা যাবে এভাবে— 


আণবিক সংকেতের যৌগের ভর ÷ স্থুল সংকেতের যৌগের ভর = x


এখন প্রশ্ন স্থুল সংকেত কীভাবে বের করব?

শতকরা সংযুতি থেকে। চলো বের করি৷ 

দেওয়া আছে, প্রতি 100 g যৌগে, 

C আছে 92.31 g 

H আছে 7.69 g 

আমরা জানি, C এর মোলার ভর বা ১ মোলের ভর 12 g। 

12 g C এ পরমাণু আছে 6.023 × 10²³ টি 

1 g C এ পরমাণু আছে 6.023 × 10²³ ÷ 12  টি 

.'. 92.31 g C এ পরমাণু আছে (92.31/12)(6.023 × 10²³) টি 


H এর এক মোল ভর 1 g 

1 g H এ পরমাণু আছে 6.023 × 10²³ টি 

7.69 g এ পরমাণু আছে (7.69/1)(6.023 × 10²³) টি 


যেহেতু, স্থুল সংকেত হলো পরমাণু সংখ্যার অনুপাত;

.'. যৌগের আণবিক সংকেত, 

n(C) / n(H)

 = [(92.31/12)(6.023 × 10²³)] ÷ [(7.69/1)(6.023 × 10²³)]

= (92.31/12) ÷ (7.69/1)

= 7.69 ÷ 7.69 

= 1/1 


.'. C : H = 1 : 1 

.'. স্থুল সংকেত = CH 


বিশেষ দ্রষ্টব্য: n(C)/n(H) এ 6.023 × 10²³ সংখ্যাটি বাদ হয়ে যাচ্ছে। তাই স্থুল সংকেত বের করতে সরাসরি C ও H সংখ্যার বদলে তাদের মোল সংখ্যা মানে কোনো পরিমাণে কত মোল আছে, সেটা নিতে পারি৷ যা C এর ক্ষেত্রে 92.31/12 এবং H এর ক্ষেত্রে 7.69/1 । 


মোল সংখ্যা নেওয়ার কারণ মোল সংখ্যা দিয়ে বোঝায় ওই মৌলতে বা পরিমাণে কত মোল পরমাণু আছে, যা পরোক্ষভাবে সংখ্যাকেই নির্দেশ করে। 

আমরা স্থুল সংকেত পেয়ে গেছি। এবার x বের করতে হবে৷ 

স্থুল সংকেত : CH  [এখানে, CH এর ভর 13]

আণবিক সংকেত : (CH)ₓ 

এখন,

x = আণবিক সংকেতের যৌগটির ভর ÷ স্থুল সংকেতের যৌগটির ভর 

= 78/13 

= 6 

.'. আণবিক সংকেত = (CH)₆ = C₆H₆


তো এই ছিল রাসায়নিক গণনার আলোচনা। আমি মূলত চেয়েছি যুক্তির সাথে আলোচনা করতে, যাতে মজাটা উপভোগ করা যায়। আসলে বিজ্ঞানে যুক্তি ছাড়া কিছুই হয় না। তাই যুক্তির সাথেই আছে প্রকৃত মুক্তি!


পরিশিষ্টঃ

শতকরা সংযুতিঃ- 

       এই ধারণাটা একেবারে সহজ। সাধারণত বিজ্ঞানীরা প্রায়ই বিভিন্ন যৌগ এনালাইসিস করে থাকেন। কোনো যৌগের ১০০ গ্রাম এনালাইসিস করে তার মধ্যে থাকা মৌলগুলো যতগ্রামে পাওয়া যাবে তাকে ঐ যৌগে ঐ মৌলের শতকরা সংযুতি বলে। যেমন আমি ১০০ গ্রাম সোডিয়াম ক্লোরাইডকে বিশ্লেষণ করে পেলাম। সেখানে ৫০ গ্রাম সোডিয়াম আছে। তাহলে NaCl এ Na এর শতকরা সংযুতি ৫০%।


মোল সংখ্যাঃ-

      মোল সংখ্যা হলো কোনো একটা পদার্থের পরিমাণ থেকে সেটা কত মোল আছে তা বের করা।


যেমন, ১০ গ্রাম NaCl এ কত মোল NaCl আছ?


আমরা মোলের ধারণাকে বিস্তৃত করলেই দেখব, কোনো যৌগের আনবিক ভরকে গ্রামে প্রকাশ করলেই পাব মোলার ভর। এখন কেউ ভাবতে পারেন, NaCl তো অণুই গঠন করে না। তার আনবিক ভর আসবে কিভাবে? এর উত্তর আমি বলব না, আপনারা ভাবুন। 

NaCl এর মোলার ভর ৫৮.৫ g


58.5g NaCl →1 mol

1 g  NaCl →1÷58.5 mol

10 g NaCl →10 ÷ 58.5 mol


১০ গ্রাম NaCl  ০.১৭০৯৪ মোল প্রায়। এখন কি আমরা বলতে পারি, ১০ গ্রাম NaCl এর ক্রিস্টালে  কয়টা NaCl আছে? ০.১৭০৯৪ সংখ্যার সাথে অ্যাভোগেড্রো সংখ্যা গুণ করলেই হয়ে যাবে। কারণ 

১ মোল = ৬.০২৩ × (১০)^ ২৩ টি। 




কৃতজ্ঞতাঃ কেমিস্ট্রির প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে শেখ মুহাম্মদ আরমান ভাইয়ের কারণে। তাকে  অনেক অনেক ভালোবাসা! 

                          —————


Oyahidur Rahman Mohin

I am Mohin. Reading, writing and thinking are my passion. I usually write fiction and non-fiction for pleasure. And I am trying to touch the tune of life. "Life is really very simple but we insist on making it complicated."

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম