ঝনঝন করে কাঁচ ভেঙে গেল। কোথায় ভাঙল তা বোঝার চেষ্টা করেছি, আবছা অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। সবকিছু কেমন ঘোলাটে! আমি হাতরে হাতরে আলো জ্বালার জন্য মোমবাতি খুঁজছি। মোম আর ম্যাচ একসাথেই পেয়ে গেলাম। আগুন জ্বালিয়ে মোমবাতিতে ছোঁয়ানোর সাথে সাথেই ঘর অন্ধকার হয়ে গেল!আমি আঁতকে উঠলাম।
এভাবে কতক্ষণ কাঁটল আমার খেয়াল নেই। ভয়ে আমার শরীর ভিজে উঠেছে। এমন সময় চারদিকে একটা নীল আলো ছড়িয়ে পড়লো, আমি দেখলাম আমার চোখের সামনে কে যেন বসে আছে। আমি লাফ দিয়ে ওঠলাম, কিন্তু কোন শব্দ করতে পারলাম না!
লোকটার একটা চোখ যন্ত্রের মতো, সেখান থেকে একটা সাদা আলো বের হচ্ছে। তার একটা কানও যন্ত্রের, মনে হচ্ছে মুখটা আধা যন্ত্র আর মাংসের তৈরি। সে বলে উঠলো,
আমাকে দেখে কি খুব ভয় হচ্ছে?
তারপর তার সেই যান্ত্রিক হাত দিয়ে আমার বাম চোখটা চেপে ধরল, মনে হচ্ছে এখনি অক্ষিকোটর থেকে চোখটা বের হয়ে যাবে। একটা বিশ্রী তরল পদার্থ আমার ঠোঁট বেয়ে পড়ছে। আর তখন বুঝতে পারলাম আমার চোখ থেকে রক্ত বের হচ্ছে।
আমি বিকট একটা চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। চারদিকে কেউ নেই, আমার পাশেই লেম্পের আলো জ্বলছে। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। এটা স্বপ্ন ছিল, দুঃস্বপ্ন। আমি আবারও ঘুমোতে গেলাম, কপালে হাত রাখতেই দেখি বাম চোখের অক্ষিকোটর খালি!
রোবট
গল্পে আমরা যেই আধা যন্ত্র আর মাংসের মিশ্রণের বিমূর্ত লোকটাকে দেখলাম সেটা কিন্তু শুধু একটা ধারণা না! এদের বলে সাইবর্গ। এরা এক ধরণের বিশেষ রোবট! এরা যন্ত্র আর মাংসের মিশ্রণে তৈরি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রোবট কি?
আমরা ভাবি মানুষের মতো দেখতে হবে একটা রোবট, যেটা যন্ত্র দিয়ে তৈরি। কিন্তু রোবট যে মানুষের মতো দেখতে হবে তার কোন ধরাবার নেই।
যদি কোন যন্ত্র মানুষের মতো দেখতে হয়। কিংবা মানুষের মতো কাজ করতে পারে সেটাই আসলে রোবট। অনেক সময় কিছু রোবটের মধ্যে এই দুইটা বৈশিষ্ট্যেরই মিশ্রণ ঘটে। রোবটের ধারণা মানুষের মধ্যে আসে কষ্ট কমানোর চিন্তা থেকে। এটা এখন আর আমাদের কাছে নতুন কিছুই না।
গণিতবীদ প্যাসকেল একটা গণনাযন্ত্রের তৈরি করেন আর এটাই আসলে পরবর্তীতে রোবটের ধারণাকে আরো শক্ত করে। আমরা এখন প্রায়ই দেখি রোবট চিন্তা করতে পারে। চিন্তা করে দাবা খেলতে পারে। কিন্তু কিভাবে? রোবটরা এটা করে যুক্তিতত্ত্বের সাহায্যে। যেটা নিয়ে এখন গণিতের একটা শাখাও গড়ে উঠেছে। রোবট কিন্তু এখন বাচ্চাদেরও সঙ্গী, তারা প্রায়ই বিভিন্ন খেলনা রোবট নিয়ে খেলে আর মুগ্ধ হয়ে তার কাজগুলো দেখে।
যেই রোবট আমাদের এতো কাছের সঙ্গী, যে কিনা আমাদের জীবনের ঝুঁকি থেকে বাঁচিয়ে নিজেকে ঝুঁকিতে ফেলে সে কি আমাদের কখনো ক্ষতি করতে পারে?
সিকাগো বিশ্বমেলায় রোনাল্ড সাফার একটি রোবট প্রদর্শন করেন। এই রোবট কাঠমিস্ত্রির মত কাঠ কাটতে পারত, পেরেক লাগাতে পারত, ভারী জিনিস এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিতে পারত। সাফার এই রোবটটা তৈরি করে ভীষণ খুশি।
একদিন সাফার তার গবেষণাগারে বসে নকশা তৈরি করছে। হঠাৎ কিছু সন্দেহজনক শব্দ শুনল, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে মনে হয়। সাফার কাজ রেখে কোথায় গোলমাল হয়েছে দেখতে গেল। সাফার দেখছে কি সমস্যা, এমন সময় পিছন থেকে তার রোবট এসে একটা ভারী লোহা দিয়ে সাফারের মাথায় প্রচন্ড শক্তিতে বাড়ী দিল। আর খুলি ফেটে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল তার মস্তিষ্ক! সাফার সেখানেই শেষ। তারপর রোবটটি গুড়িয়ে দিল গবেষণাগার আর নিজেকে!
কিন্তু কেন করল সেই রোবট? তদন্ত করে পাওয়া গেল অজ্ঞাতনামা এক লোকের নির্দেশনায় রোবটটি তার স্রষ্টাকে মেরে ফেলে। তাই শুধু প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটালেই চলবে না, উন্নয়ন ঘটাতে হবে আমাদের!
প্রযুক্তির সাথে আমরা
এখন গ্রীষ্মকাল, প্রচুর গরমে আমাদের অবস্থা সবসময়ই দিশেহারা থাকে। বাংলাদেশে নাকি সর্বোচ্চ গরমের রেকর্ড আছে ৪২° সেলসিয়াস। এই গরমে স্বাভাবিকভাবেই আমরা এসির বাতাসে হারিয়ে যেতে চাইব। কিন্তু যদি ইলেক্ট্রিসিটি চলে যায়? তখন নিশ্চয়ই জেনারেটর ব্যাবহার করা লাগবে! এটা ছাড়াও আমরা অনেক ক্ষেত্রেই জেনারেটর ব্যাবহার করি। নিজেদের আরামের জন্য।
সময়টা ছিল ২০০০ সাল, আমেরিকার অ্্যারিজোনা রাজ্যের পাওয়েল লেকে ঘুরতে যায় একপরিবার। সেখানে ছিল দুইজন ছেলে আর তাদের বাবা-মা। তারা বেড়াতে গিয়ে সুন্দর মুহুর্তে পার করল। এখন তারা সিদ্ধান্ত নিল ভোটে ভেসে ঘুরবে। যেই ভাবনা সেই কাজ। ঘুরছে দেখছে আর সুন্দর মুহূর্ত পার করছে। দুপুরে বাবা-মা ঘুমিয়ে গেলে ছেলে দুটো ভাবল এই ঝলমলে পানিতে গোসল করবে। তারপর আয়োজন করে দুইজনে লাফ দিল, কিন্তু তারপর আর উঠতে পারল না।
ঘুম থেকে জেগে বাবা-মা দেখে তাদের ছেলেরা মারা গেছেন, তারা পুরো ভেঙ্গে পড়ল। তাদের ছেলে খুব ভালো সাঁতার জানে, তাই ডুবে মরার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। হাসপাতাল থেকে জানা গেল তাদের মৃত্যু হয়েছে বিষক্রিয়ায়। কিন্তু বিষ কিভাবে আসল পানিতে? সবাই যে বোট দিয়ে ঘুরছিল সেটাতে ছিল জেনারেটর চালিত এসি। জেনারেটরের গ্যাস বের হওয়ার পাইপটা পাটাতনের নিচ দিয়ে গিয়েছিল পানির মধ্যে। জেনারেটর থেকে প্রায়ই কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস বের হয়। এই কার্বন মনোক্সাইডের কোনো ঘ্রাণ, রঙ কিছু নেই যাতে তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। কিন্তু এই গ্যাস আমাদের ফুসফুসে গেলে হসপিটালাইজড না করলে মৃত্যু নিশ্চিত। জেনারেটর থেকে কার্বন মনোক্সাইড বের হয়ে পানিতে মিশে যায়। আর যখন দুইভাই পানিতে লাফ দিল তখন কার্বন মনোক্সাইড তাদের ফুসফুসে গিয়ে তারা মারা যায়!
কেন কার্বন মনোক্সাইড এতো ভয়ংকর?
আমাদের রক্তে হিমোগ্লোবিন প্রোটিন থাকে, এটা অক্সিজেনের সাথে মিশে অক্সিহিমোগ্লোবিন তৈরি করে। রক্ত যখন বিভিন্ন কোষে পৌছায় তখন এই অক্সিহিমোগ্লোবিন অক্সিজেন আর হিমোগ্লোবিনে ভেঙে যায়। এভাবে আমাদের দেহে অক্সিজেন পরিবহন হয়। হিমোগ্লোবিন কার্বন মনোক্সাইডের সংস্পর্শে এসে তার অক্সিজেন সাপ্লাই করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তাই কার্বন মনোক্সাইড এতো ভয়ংকর। শরীরের অর্ধেক হিমোগ্লোবিন কার্বন মনোক্সাইডের কবলে পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত।
আমরা আমাদের আরামের জন্য ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করি কিন্তু সেটাই যদি আমাদের মৃত্যুর কারণ হয়, তখন কি করব!
খান একাডেমি
কিছুদিন আগে আমি ভগ্নাংশ সম্পর্কে জানার জন্য আমি কিছু ভিডিও খুঁজছিলাম। বাংলায় ভালো ভিডিও পাচ্ছিলাম না। তারপর হঠাৎ একদিন গুগল প্লে স্টোরে খান একাডেমির সফটওয়্যার দেখলাম। আর তখনই খান একাডেমির সাথে আমার পরিচয়। সেখানে বাংলা ভাষায়ও অনেক ভিডিও দেখলাম। খুব সুন্দর ভিডিওগুলো দেখে আমার অনেক ভালোও লাগলো। তাই আজকে কথা বলবো খান একাডেমি নিয়ে, যেটা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে নিরন্তর সাহায্য করে যাচ্ছে।
খান একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা হলেন সালমান খান। তবে তিনি সাল খান নামেই পরিচিত। তিনি MIT আর Harvard থেকে গণিত, তড়িৎ ও কম্পিউটার প্রকৌশল আর ব্যাবসা প্রশাসনে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। তারপর হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে এমবিএ করেন। এতো পড়াশোনা শেষ করে তিনি মাত্র ওয়াল স্ট্রিটে কাজ শুরু করেছেন। সাল খানের কাজিন নাদিয়া গণিতে ভীষণ খারাপ। এই দিকে খান সাহেব আবার গণিতে স্নাতক ডিগ্রী পেয়েছেন। নিজের কাজিন গণিতে দুর্বল এটা তিনি মানতে পারলেন না। আবার নাদিয়া ম্যাডামের বাসাও অদূরে। তাই খান সাহেব ভিডিও বানানো শুরু করলেন। কিভাবে যেন চারদিকে এর খবর ছড়িয়ে যায়। তারপর বিভিন্ন মানুষ তাকে আরো টিউটোরিয়াল বানাতে বললেন। তিনি মানুষের কথায় উৎসাহ পেয়ে ইউটিউবে খান একাডেমি নামে একটা চ্যানেল খুললেন। আর শুরু হলো মানুষের বিনামূল্যে শিক্ষা লাভের সুযোগ যা এখনো চলমান।
২০১০ সালে গুগল "প্রজেক্ট টেন টু হান্ড্রেড" এ খান একাডেমি বিজয়ী হয়। গুগল তাকে ২ মিলিয়ন ডলার দিয়ে আরো কোর্স তৈরি করতে উৎসাহ দেন আর বলেন জনপ্রিয় ভাষায় তার অনুবাদ করতে। খান একাডেমিতে শুধুমাত্র গণিত ও বিজ্ঞানভিত্তিক ৬৫০০ এর বেশি ভিডিও আছে! বাংলা ভাষায়ও এর কিছু ভিডিও অনুবাদ আছে। কিন্তু বেশিরভাগই বাংলা ভাষায় নেই।
খান সাহেব তো সেই ওয়াল স্ট্রিটের চাকরি করে অনেক অনেক টাকা আয় করতে পারতেন। কিন্তু কেন তিনি সেই চাকরি ছেড়ে ভিডিও বানাতে শুরু করলেন?
সালমান খান বলেন,"বুড়ো বয়সে যখন মৃত্যু শয্যায় থাকবো আর ভাববো সারা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে আমি সাহায্য করতে পেরেছি জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে। এর চেয়ে সুখকর অনূভুতি আর কিই বা হতে পারে।"
আসলেই যারা এভাবে নিঃস্বার্থ ভাবে মানুষকে সাহায্য করে যায় তারা কখনো দুঃখী হন না। তাদের প্রতি অনেক অনেক সম্মান!
❝Providing a high quality education to anyone,anywhere.❞
– Khan Academy
এডা ল্যাবলেস ও প্রোগ্রামিং
কম্পিউটার আমাদের সুপরিচিত যন্ত্র, কিন্তু এটা কিভাবে কাজ করে?
চার্লস ব্যাবেজ একজন বিজ্ঞানী ও গণিতবীদ তিনি ডিফারেন্স ইঞ্জিনের ওপরে কাজ করে একটা গণনাযন্ত্র বানানো যেটা আপনি আপনি কাজ করবে। ব্যাবেজ এমন একটা যন্ত্র বানাতে সক্ষমও হন। এডা ল্যাবলেস যখন এই মেশিন দেখলেন তিনি চিন্তা করলেন, যদি আমরা এই মেশিনকে কিছু পদ্ধতি শিখিয়ে দেই কিভাবে কোন কাজ করা সম্ভব তাহলে সে যেকোনো কাজ করতে পারবে। গণনা করা, গান গাওয়া, দাবা খেলা যেকোনো কিছু সম্ভব হবে। তখন এডা এমন কয়েকটা পদ্ধতিও লিখে ফেলেন আর সূচনা করেন প্রোগ্রামিংয়ের। তাই এডা ল্যাবলেসকে বলা হয় প্রথম প্রোগ্রামার।
১৮২০ সালে মার্কিনরা নতুন এক কম্পিউটার তৈরি করে আর এডা ল্যাবলেসের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কম্পিউটারটার ভাষার নাম করা হয় Ada!
তথ্যসূত্রঃ-
ঝাকানাকা বিজ্ঞান - খান একাডেমির তথ্য
হাইজেনবার্গের গল্প- কার্বন মনোক্সাইডের ঝুঁকি
বিজ্ঞানীদের কান্ডকারখানা ০২- এডা ল্যাবলেসের কাহিনী।
রোবট এলো কেমন করে - রোবট আর সাইবর্গের ধারণা