হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন কিভাবে জারণ-বিজারণ ঘটায়?

১. বিক্রিয়া কেন হয়?


রাসায়নিক বিক্রিয়া নিয়ে আমাদের একটা ভ্রান্ত ধারণা থাকে। সেটা হলো দুইটা মৌল বা যৌগ মিলে অন্য একটা যৌগ বানালে সেটা রাসায়নিক বিক্রিয়া। কিন্তু রাসায়নিক বিক্রিয়া বলতে বোঝায় একটা অথবা একের বেশি মৌল বা যৌগ থেকে যখন ভিন্ন ধরনের যৌগ বা মৌল তৈরি হওয়া। এখানে মূল শর্ত হলো ভিন্ন ধর্মের মৌল তৈরি করা। সেখানে তারা একত্রিত হবে নাকি ভেঙে যাবে সেটা মূল না। 


 “রাসায়নিক বিক্রিয়া হয় কেন?” এটা খুবই সুন্দর একটা প্রশ্ন! প্রকৃতির একটা নিয়ম হলো, সবকিছুই সাম্যাবস্থায় যেতে চায়। (কিন্তু কেন?) আর এই সাম্যাবস্থায় যাওয়ার জন্যই বিক্রিয়া হয়। শুধু বিক্রিয়াই না জগতে সামগ্রিক কীর্তি কারখানার পিছনে গুটি নাড়ে এই সাম্যাবস্থা। 

যেমন, একটা পেন্সিলের পিনের কথা ধরি। পেন্সিলের পিন কার্বন দিয়ে বানানো হয়। সেখানে কার্বন গ্রাফাইট রূপে থাকে। আর বাতাসে থাকে অক্সিজেন। তাহলে পেন্সিলের কার্বন আর অক্সিজেন বিক্রিয়া করে কার্বন-ডাই অক্সাইড তৈরি করে না কেন?

 কারণ পেন্সিলে থাকা কার্বন আগে থেকেই স্থীতিশীল। যা তার গ্রাফাইট রূপ। আমি যদি পেন্সিলের পিনে তাপ দেই তাহলে সেখানে স্থীতিশক্তি জমা হবে। যার কারণে সে তার স্থীতিশীলতা হারিয়ে ফেলবে। তখন কার্বন বলবে, আমাকে তাপ দিলে কেন? কি সুখী সংসার আমার ছিল, গোছানো সংসার! আমি সংসার করব।


এইজন্য কার্বন নতুন সংসার করার জন্য মানে আবার স্থীতিশীল হওয়ার জন্য তার কাছে  জমা শক্তি খরচ করে বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে নতুন সংসার শুরু করবে। যেটা কার্বন-ডাই অক্সাইড। মোট কথা হলো, বিক্রিয়া ঘটানোর জন্য কোনো কিছুকে অস্থিতিশীল বা রিয়েক্টিভ করতে হবে। এখানে একটা বিষয় খুব ইন্টারেস্টিং। সেটা হলো, বিক্রিয়া ঘটানোর জন্য আমরা তাপ দেই বা প্রকৃতি তাপ সরবরাহ করে, কিন্তু সেই তাপ কি সবসময়ই সমানভাবে প্রকৃতিতে ফেরত আসে? উত্তর হলো, না। সেটা নিয়ে অন্য কোথাও বিস্তারিত বলা যাবে। আপাতত আমরা জারণ-বিজারণ নিয়েই থাকি!


রাসায়নিক বিক্রিয়ার অনেক ভাগ আছে। যেমন, ইলেক্ট্রনের আদান-প্রদানের হিসাবে রেডক্স বিক্রিয়া। যেখানে অনু-পরমাণুগুলো ঘর বাঁধে, কখনো বিবাগী হয়। আবার কখনো নির্যাতনের শিকার হয়ে হার মানে। আজকে সেই রেডক্স বিক্রিয়ার ইতিহাস ও ম্যাকানিজিম নিয়ে কথা হবে। 


. জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া (Redox):-


জারণ বিক্রিয়াকে ইংরেজিতে বলে Oxidation আর বিজারণকে বলে Reduction. 

ইতিহাসে এই বিক্রিয়া নিয়ে দুই ধরনের মতবাদ আছে। 


i. সনাতন মতবাদঃ– 


প্রাচীনকালে জারণ বিজারণকে দুইটা মৌলের ভিত্তিতে চিহ্নিত করা হতো–


১. হাইড্রোজেনের ভিত্তিতেঃ- 


কোনো বিক্রিয়া থেকে হাইড্রোজেন মুক্ত হলে সেই বিক্রিয়াকে জারণ বিক্রিয়া বলা হতো।আবার কোনো বিক্রিয়ায় হাইড্রোজেন যুক্ত হলে তাকে বিজারণ বিক্রিয়া বলা হতো। যেমনঃ- 

N2 + 3H2 → 2NH3



২. অক্সিজেনের ভিত্তিতেঃ- 


 কোনো বিক্রিয়ায় অক্সিজেন যুক্ত হলে প্রাচীন যুগে মানুষ সেটাকে জারণ বিক্রিয়া বলত। আর অক্সিজেন মুক্ত হলে সেটাকে ভাবত বিজারণ বিক্রিয়া। পরে তারা আরিকটু বিস্তারিত মত দিল। অক্সিজেন জাতীয় কোনো মৌল (অধাতু) বিক্রিয়ায় যুক্ত হলে সেটাকে বলত জারণ আর মুক্ত হলে  তাকে বলত বিজারণ। যেমনঃ- 

  

      C + O2 → CO



ii. আধুনিক মতবাদঃ-


 আধুনিক মতবাদটা ইলেক্ট্রনের আদান-প্রদান এর উপর ভিত্তি করে সংজ্ঞায়িত। বিক্রিয়ায় তো বিভিন্ন পরমাণু নিজেদের মধ্যে বন্ধন তৈরি করে। বিক্রিয়ায় এভাবে বন্ধন তৈরি করে নতুন কিছু তৈরি করার সময় যখন কেউ ইলেক্ট্রন ছেড়ে দেয় তখন সেটাকে বলে জারণ বিক্রিয়া। আর যদি কেউ ইলেক্ট্রন গ্রহণ করে সেটাকে বিজ্ঞানীরা বলেন বিজারণ বিক্রিয়া। 


সবসময় জারণ-বিজারণ নামটা একত্রে বলা হয়। কারণ যখন একজন ইলেক্ট্রন ত্যাগ করে, অন্যজন তা নিয়ে নেয়। বা বলা যায়, কেউ ইলেক্ট্রন নিবে বলেই অন্যজন দিয়ে দেয়। একটা সুখি সংসার। যেমন, লবণের বিক্রিয়া। 

আবার কিছু লোভী বিক্রিয়াও আছে। যেমন, 


Zn + H2SO4 →ZnSO4 + H2


এখানে হাইড্রোজেন সালফেটের H2SO4  একটা সুখের সংসার। কিন্তু কালপ্রিট হাইড্রোজেন লোভে অন্ধ হয়ে জিংকের থেকে টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। আর জিংক নিঃসঙ্গ সালফাইটকে সঙ্গ দিতে গিয়ে হয়ে যায় ZnSO4। কিন্তু হাইড্রোজেন অনেক টাকা পেলেও সুখি হতে পারে নি। তাকে থাকতে হয়েছে একা একা। উপমা যত মজার ভিতরের কারবার তার চেয়েও বেশি মজার। একবার ভাবো, মানুষের আবেগ আছে তাই এগুলো খুবই সহজবোধ্য আমাদের কাছে। কিন্তু কণাদের কি তা আছে? না থাকলে তারা এমন অদ্ভুতুরে কাণ্ডকীর্তি কেন করে? এটা আসলে দীর্ঘ অনুসন্ধান ও ভালোবাসার একটা ব্যাপার, যার একটুখানি আমি এখানে তুলে ধরতে চাই। 


Redox  বিক্রিয়ার নামকরণটা খুবই সুন্দর। এর নাম রাখা হয়েছে প্রাচীন ও আধুনিক দুই মতবাদের মিশ্রণে। বিজারণ বিক্রিয়ায় ইলেক্ট্রন গ্রহণ হয়। ফলে চার্জ কমে যায় (Cl + e →Cl- ) বা Reduced হয়। আবার  জারণ বিক্রিয়ায় অক্সিজেন যুক্ত হয় সেটাকে বলে Oxidation।  এই Reduced থেকে Reduction, সেখান থেকে Red আর Oxidation এর Ox মিলেই হয় Redox। 


৩. রেডক্স বিক্রিয়ার গহীনে


রেডক্স বিক্রিয়ায় কেন সনাতন মতাবাদে অক্সিজেন যুক্ত হলে জারণ বিক্রিয়া হয় তা একটু দেখি। 

জারণ বিক্রিয়া মানে ইলেকট্রন ছেড়ে দেওয়া। কোনো একটা যৌগের সাথে অক্সিজেন যুক্ত হবে তখন যখন অক্সিজেন স্থিতিশীল হতে পারবে। আর সেই জন্য অক্সিজেন ইলেকট্রন গ্রহণ করবে আর যেখান থেকে গ্রহণ করবে সেটা ইলেকট্রন ছেড়ে দিবে, জারণ হবে। মোদ্দা কথা হলো কোনো কিছুর সাথে অক্সিজেনযুক্ত হলে অক্সিজেন নিজে বিজারিত হয় ঠিকই কিন্তু অন্য মৌল বা যৌগমূলকের জারণ ঘটে। যেহেতু অক্সিজেন অন্য মৌলকে জারিত করে বা ইলেক্ট্রন ছাড়তে সাহায্য করে তাই সে জারক ( যা অন্যে জারণ ঘটায়)। তাই যার জারণ ঘটে তাকে বিজারক আর যার বিজারণ ঘটে তাকে জারক বলে। এখন একটু উদাহরণে যাই,

C + O2 →  CO2

 এইখানে, কার্বন ডাই অক্সাইড কিন্তু সমযোজী যৌগ। তাই এখানে মুক্ত আয়ন থাকবে না, থাকবে আংশিক ঋণাত্মক ও ধনাত্মক আয়ন।  বিক্রিয়াটা খেয়াল করলে দেখতে পাবে, কার্বনের শেয়ারকৃত চারটা ইলেকট্রন অক্সিজেন নিজের দিকে টেনে নেয় বা শেয়ারকৃত ইলেক্ট্রনগুলো অক্সিজেনের দিকে সামান্য হেলে থাকে। ফলে অক্সিজেন আংশিক ঋণাত্মক ও কার্বন আংশিক ধনাত্মক মৌলে পরিণত হয়। মানে কার্বনের জারণ হয়েছে। আর অক্সিজেন যেহেতু  ইলেক্ট্রন নিজের দিকে টেনে নেয় তাই তার বিজারণ ঘটেছে। 

জারণঃ C – 4e- →C4+

বিজারণঃ 2O+4e- → 2O2-


এখন, উলটা চাল চালব। অর্থাৎ বিক্রিয়া হবে এমন,

CO2 → C + O

আগের আলোচনা থেকে বোঝা যায় কার্বন ডাই-অক্সাইডে কার্বন C4+  (আংশিক ধনাত্মক) ও অক্সিজেন O2- (আংশিক ঋণাত্মক) তাই ভেঙে গেলে কার্বনের চারটা ইলেকট্রন তার কাছে চলে আসবে এবং অক্সিজেন ইলেক্ট্রনদের ছেড়ে দিবে। সর্বোপরি ঘটনাটা এভাবে দেখানো যায়,

বিজারণঃ C4+ + 4e- → C

জারণঃ 2O2- - 4e- → O



অক্সিজেনের বের হওয়ার ফলে কার্বনে বিজারণ হয়। অক্সিজেনে ব্যাপারটা বোঝা গেলে হাইড্রোজেনেরটাও বোঝা যাবে। তবে সেটা তোমরা নিজেরা অনুসন্ধান করবে। দুইটা বিক্রিয়া দিয়ে দিচ্ছি,

  • Zn + 2HCl → ZnCl2 + H2

  • N + 3H2 → 2 NH3

প্রথম বিক্রিয়ার জন্য একটু সাহায্য করি, এখানে ক্লোরিনের কোনো ইলেকট্রন আদান প্রদান হবে না। কেন? সেটা নিজে বের করার চেষ্টা করে ষোল আনা

মজা লুটে নাও!





কার্বন ডাই-অক্সাইডের বিক্রিয়া দেখানোর সময় একটা কথা মনে হলো! কার্বন কিন্তু যেকোনো পরিবেশেই বিক্রিয়া করতে পারে। মানে তোমার বাসায় একটা কাঠের টুকরা রেখে দিলে সেটা অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি করবে! তোমার কোনো কষ্ট করতে হবে না। তাহলে আমরা বাসায় কাঠ রেখে দিলে তা অক্ষত দেখি কেন বলো তো? আবার কোনো তাপ না দিলেও পানি থেকে কিছু জলীয়বাষ্প বের হয়, জলীয় বাষ্পও পানি হয়! কেন এই আচরণ তা কি আমরা কখনো ভাবি? সত্যি বলতে কি, অণু-পরমাণুর এই অদ্ভুত আচরণ আমাদের চোখের সামনেই ঘটে।  শুধু একটুখানি অনুভব করলেই সেই জগতটাকে বোঝা যায়!


সূত্রঃ 
১. উচ্চমাধ্যমিক স্তরের রসায়ন বই
২. সিক্স ইজি পিসেস- রিচার্ড ফাইনম্যান।  (অনুবাদঃ উচ্ছ্বাস তৌসিফ) 

Oyahidur Rahman Mohin

I am Mohin. Reading, writing and thinking are my passion. I usually write fiction and non-fiction for pleasure. And I am trying to touch the tune of life. "Life is really very simple but we insist on making it complicated."

1 মন্তব্যসমূহ

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম