রসায়নের মহাকাব্যঃ জৈবযৌগ (পর্ব ১)



পর্ব ০১ঃ জৈবযৌগের বৈশিষ্ট্য  ও কার্বনের জয়জয়কার 



   আমি প্রথম থেকেই জানতাম এই নীলা আসল নীলা না। কারণ মৃত মানুষ কিভাবে ফিরে আসবে? ঐদিন এই কিচেনেই নীলা আমার কাছে মাফ চেয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করার জন্য বলেছিল। কিন্তু আমার কাছে ধোঁকার কোনো ক্ষমা নেই। আমি রাগ সামলাতে পারি নি। আমার হাতের ধারালো ছুরি দিয়ে আমি আমার নীলাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলি। আমি এতটুকু স্মার্ট ছিলাম যে, জানতাম যদি পুলিশ নীলার লাশ খুঁজে পায় তাহলে আমার ফাঁশি নিশ্চিত। তখন কে যেন আমার কানে ফিসঁ ফিসঁ করে বলল, "রাফসান হকের খাবার কি কখনো খারাপ হতে পারে?" আর আমি সেটাই করলাম, আমি জানতাম আগামীকাল রাশেদ চৌধুরীর ছেলের জন্মদিনের বুকিং। আমি আমার প্রিয় নীলাকে আমার এক্সপার্ট হাত দিয়ে কুচি কুচি করে কেঁটে সার্ভ করলাম। আর সেই খাবার খেয়ে এখনো মানুষ প্রশংসা করে। 



১. 



রাফসান যদি নীলাকে খাবার না বানিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতো, তাহলে কি হতো? তাহলে নীলার শরীর অনুজীবরা খেয়ে ফেলত। আর তার শেষ পরিণতি হতো প্যাট্রোলিয়াম। প্যাট্রোলিয়াম একটা জৈবযৌগ। কিন্তু কেন? এটা একটা জীবদেহ থেকে পাওয়া যায়, তাই? আমরা এখন এইসব প্রশ্নেরই উত্তর জানব, জৈব যৌগকে বোঝার চেষ্টা করব।



রসায়নবিজ্ঞান কাজ করে অণু-পরমাণুর আচরণ ও জীবন কাহিনি নিয়ে। এই অণু-পরমাণুর আচরণ, জীবন কাহিনি ও আমাদের জীবনে এদের প্রভাব নিয়ে কাজ করতে গিয়ে রসায়নবিজ্ঞানের চারটি শাখা চালু হয় – 



১. অজৈব রসায়ন  


২. ভৌত রসায়ন


৩. বিশ্লেষণাত্মক রসায়ন


৪. জৈব রসায়ন



এখানে অজৈব রসায়ন কাজ করে প্রকৃতির ১১৮ টি মৌলের মধ্যে ১১৭ টিকে নিয়ে। আর Organic chemistry বা জৈবযৌগ কাজ করে ১টা মৌল নিয়ে, শুধু মাত্র কার্বনকে নিয়ে! কী অবাক করা ব্যাপার। একটা, শুধুমাত্র একটা মৌলের জন্য আলাদা একটি শাখা। এখানেই বিস্ময় শেষ না। এই একটা মৌল বা কার্বনকে নিয়ে যে শাখা সেটা ১১৭ টা মৌলকে নিয়ে গড়ে ওঠা শাখার চেয়ে কয়েকগুণ বড়! একটা মৌল কেন এত বড় শাখা তৈরি করল? কারণ প্রকৃতিতে ১১৭ টা মৌল যে পরিমাণ যৌগ তৈরি করতে না পারে, একলা কার্বন তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি যৌগ তৈরি করতে পারে! কিন্তু কেন, কি আছে এই কার্বনে যা অন্য কারো নেই? এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগে কিছুটা ইতিহাস ঘেঁটে আসি। বোরিং কোনো ইতিহাস না, মজার ইতিহাস, বোকামির ইতিহাস। 



২.



ক্যামিস্ট্রি বিজ্ঞানের সবচেয়ে পুরাতন শাখা। মানুষ অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন যৌগকে চিনত, বোঝার চেষ্টা করত। আর তখন থেকেই তারা যৌগকে দুইভাবে ব্যাখ্যা করত–



◑ জৈবযৌগ ও


◑ অজৈব যৌগ



প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ দেখত অজৈব যৌগ ল্যাবে বানানো যায়, আবার প্রাণীর দেহেও পাওয়া যায়। আর জৈব যৌগ শুধু জীবদেহে পাওয়া যায়। এই যৌগ কোনোভাবেই ল্যাবে বানানো যায় না। 


কিন্তু কেনো  এই যৌগ ল্যাবে বানানো যায় না, তার কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা একটা থিওরি দিলেন "Vital Force Theory"। এই থিওরি মতে, প্রাণীদেহে বা জীবদেহে Vital force থাকে, যা ল্যাবে বানানো যায় না। তাই কেউ যত চেষ্টাই করুক না কেন জৈবযৌগ ল্যাবে বানানো সম্ভব না। 


Vital Force এর কারণে বিজ্ঞানীরা ভাবল, এটা তো ল্যাবে বানানো সম্ভব না। তাই জৈবযৌগ নিয়ে কাজ করা অর্থহীন। তখন বিজ্ঞানীরা আর জৈবযৌগ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে অন্য জায়গায় কাজ শুরু করল। 



ভুলটা হলো, ১৮২৮ সালে।  ফ্রেডরিক ভোলার নামে এক রসায়নবিদ ভুলে অ্যামোনিয়াম সায়ানাইডকে (অজৈব যৌগ) বেশি তাপ দিয়ে ফেলে। আর তার ফলে অজৈব অ্যামোনিয়াম সায়ানাইড থেকে সম্পূর্ণ জৈব একটা যৌগ ইউরিয়া পাওয়া গেল। এটা দেখার পর ভোলার পুরো স্তম্ভিত। যেদিকে জৈবযৌগ বানানোই যায় না, সেখানে কিনা একটা অজৈব যৌগ থেকে জৈব যৌগ পাওয়া গেল। তার পরবর্তী ২০ বছর ছিল জৈবযৌগের। এই বিশ বছরে প্রায় কয়েক লক্ষ জৈব যৌগ ল্যাবে বানানো হলো। 



আর এখানে বিজ্ঞানীরা চিন্তায় পড়লেন– আগে তো বলতেন জীবদেহ থেকে যে যৌগ পাওয়া যায় তাই জৈবযৌগ। কিন্তু এখন এর ব্যাখ্যা কি হবে? 


রসায়নবিদরা দেখলেন, সব জৈব যৌগতেই থাকে কার্বন। জৈব যৌগের প্রাণই হলো কার্বন। তখন তারা ভাবল, কার্বন কেন্দ্রিক যৌগই হলো জৈব যৌগ। কিন্তু সমস্যা বাঁধল এক জায়গায়, CO, CO2  …   এগুলো তো জৈবযৌগ না। তাই তারা তাদের সংজ্ঞাকে আরও বিস্তারিত করলেন। তারা দেখলেন, সব অর্গানিক  কম্পাউন্ডসে কার্বনের চিরসঙ্গী হিসেবে থাকে হাইড্রোজেন (H)। তখন তারা বললেন, হাইড্রোজেন ও কার্বনের সমন্বয়ে যে যৌগ এবং তাদের থেকে পাওয়া যায় যেসব যৌগ, তারা জৈব যৌগ। আর এই সমন্বয়কে নাম দেয়া হলো হাইড্রোকার্বন। তাহলে জৈবযৌগ হলো, হাইড্রোকার্বন ও তাদের থেকে পাওয়া যৌগ! 



৩. 



প্রথমেই আমরা দেখেছি প্রকৃতিতে কার্বন কেন্দ্রিক যৌগ বা জৈবযৌগ অনেক বেশি। কিন্তু কেন? কি আছে এই কার্বনে?


কার্বনের ৩ টা বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলো কার্বন অনেক বেশি পরিমাণে দেখাতে পারে। সেগুলো হলো– 



 ১। ক্যাটেনেশন 


 ২। সমানুকরন 


 ৩। পলিমারাইজেশন 



এখন কার্বনের এই তিনটা বৈশিষ্ট্যকে একটুখানি জানার চেষ্টা করি। 



• ক্যাটেনেশন 


                      ক্যাটেনেশন শব্দের উৎপত্তি ক্যাটিনা (catena) শব্দ থেকে। ক্যাটিনা মানে হলো শিকল। শিকল মূলত ছোট ছোট ব্লক দিয়ে তৈরি। এই ব্লক দিয়ে ইচ্ছামতো শিকল বানানো সম্ভব। লম্বা শিকল, গোল শিকল, শাখা শিকল ইত্যাদি। এই শিকল ধর্ম কার্বনও দেখায়। কার্বন নিজেদের মধ্যে ইচ্ছামত বন্ধন তৈরি করে নিজেদের ইচ্ছামত সাজাতে পারে। কখনো শাখা বানাতে পারে, কখনো সোজাভাবে সাজাতে পারে। অন্য কোনো মৌল কার্বনের মধ্যে  এতোটা ব্যাপকভাবে এই ধর্ম দেখাতে পারে না। 


( প্রথম চিত্র দ্রষ্টব্য) 



সমানুকরন:


                Isomerization অর্থ সমাণুতা। আমরা দেখলাম, কার্বন ক্যাটিনেশন ধর্মের জন্য নিজেকে ইচ্ছেমতো সাজাতে পারে, গোল, সোজা, শাখা… ইচ্ছেমতো সাজাতে পারে। আমি যদি ৫ টা C কে আর ১২  টা হাইড্রোজেনকে নিই তাহলে তারা কিভাবে নিজেদের সাজাবে? হতে পারে তারা সরলরেখার মতো সাজাতে পারে। অথবা মূল রেখায় ৪ টা কার্বন রেখে ১ টা শাখা হিসেবে রাখতে পারে। অথবা রিং তৈরি করতে পারে।  






কী অদ্ভুত! এমনিতেই কার্বন নিজেকে বিভিন্নভাবে সাজাতে পারে, তার উপর একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার কার্বনও নিজেদের নানানরকম করে সাজাতে পারে! আর এই একেকটা গঠনকে একটার আরেকটার আইসোমার বলে। (দ্বিতীয় চিত্র দ্রষ্টব্য)





পলিমারাইজেশন:


           ক্যাটেনেশন ও  সমানুকরন এর কারণে এমনিতেই কার্বন যৌগের সংখ্যা অনেক বেশি। তার উপর আরেকটা ধর্ম হলো পলিমারাইজেশন। এটাতে নির্দিষ্ট কোনো কার্বনকেন্দ্রিক যৌগ বা নির্দিষ্ট কোনো যৌগকে জোরা লাগিয়ে নতুন যৌগ পাওয়া যায়।  যেমন আমার কাছে কোনো কোম্পানির কয়েক হাজার ইট আছে। আমি ইট জোরা লাগিয়ে বাড়ি বানিয়ে ফেললাম। তাহলে বাড়িটা হলো ঐ কোম্পানির ইটের পলিমার। আর ইটটা হলো মনোমার। যেই যৌগটাকে জোরা লাগিয়ে নতুন যৌগ পাওয়া যায় ঐ যৌগটা মনোমার, আর নতুন যৌগ পলিমার। 


এখানে আমার কাছে যৌগ থাকবে নির্দিষ্ট, কিন্তু যৌগের পরিমাণ থাকবে অনেক। ইট দিয়ে বাড়ি বানানোর মতো। 



আমি ইথিন নামে একটা হাইড্রোকার্বন নিলাম। এর বৈশিষ্ট্য হলো, দুইটা কার্বন থাকবে এই যৌগে, আর কার্বন দুইটায় ডাবল বা দুইটা বন্ধন থাকবে। আর কার্বনের বাকি খালি হাতগুলোতে থাকবে হাইড্রোজেন। এভাবে এর সংকেত হবে এমন: CH2=CH2।  কার্বনের ৪ টা হাত থাকে, যার দুইটা খরচ হয়ে যায় দুই কার্বনের বন্ধনে, আর দুই কার্বনের প্রতেকের খালি দুই হাতে ২ টা করে, মোট ৪ টা হাইড্রোজেন যুক্ত হয়। 



আমি অনেকগুলো ইথিনCH2=CH2 নিলাম (ধরি, n সংখ্যক), আমার কাজ হলো এদের জোরা লাগানো। আমি এদের জোরা লাগাতে গেলে এদের ডাবল বন্ড ভেঙে সিঙ্গেল বন্ড হবে। যার রেজাল্টে আমরা পাব ethen এর পলিমার, Polythene. এই পলিথিন আমরা সবসময় ব্যবহার করি, ইথিন থেকে পলিথিনের ধর্ম সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ পলিথিন কঠিন আর ইথিন গ্যাস। 



n(CH2=CH2) → (–CH2–CH2–CH2–)n



(–CH2–CH2–CH2–)n এটা হলো পলিথিনের সংকেত।






( তৃতীয় চিত্র দ্রষ্টব্য) 



মূলত এই তিনটা ধর্মের কারণেই কার্বন যৌগ এতো বেশি। কিন্তু আরেকটা প্রশ্ন, কার্বন কেন এতো বেশি পরিমাণে এই ধর্ম দেখায়? 


এর কারণ কার্বনের তড়িৎ ঋণাত্মকতা। সমযোজী বন্ধনে কোনো যৌগের ইলেক্ট্রনকে নিজের দিকে টানার ক্ষমতাই তড়িৎ ঋণাত্মকতা। কার্বন পর্যায় সারণির যে গ্রুপে অবস্থিত। তার তড়িৎ ঋণাত্মকতা স্পেশাল। তাই কার্বনের তড়িৎ ঋণাত্মকতা প্রায় হাইড্রোজেনের সমান। তাই জৈবযৌগে হাইড্রোকার্বন অনেক বেশি স্টেবল হয়। যার কারণে অন্য কেউ তাদের সহজে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। আর তারা নিজেদের মতো করে সংসার সাজাতে থাকে। 



বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ শুরুর ক্রাইম সিনটা আমার মৌলিক কোনো ধারণা না। এটা ভিকি জাহেদ'র "পুণর্জন্ম" নাটক থেকে ধার করা। যারা পুরো ঘটনা জানতে চান নাটকটা দেখতে পারেন ইউটিউব থেকে।











Oyahidur Rahman Mohin

I am Mohin. Reading, writing and thinking are my passion. I usually write fiction and non-fiction for pleasure. And I am trying to touch the tune of life. "Life is really very simple but we insist on making it complicated."

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম